ভূত চতুর্দশী — কালীপুজোর আগের রহস্যময় দিন
কালীপুজোর আগের দিন, অর্থাৎ অমাবস্যার আগের চতুর্দশী তিথি কে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। এই দিনটি শুধুমাত্র এক ধর্মীয় আচার নয়, এটি প্রকৃতি, শরীর ও আত্মার শুদ্ধিকরণের এক শক্তিশালী প্রতীক।
পুরাণ মতে, এই দিনে মা কালী অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন — তাই ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে, প্রদীপের মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে দূরে রাখার প্রথা চলে আসছে যুগের পর যুগ।
🪔 চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম ও কারণ
ভূত চতুর্দশীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো। এই প্রদীপগুলির মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আলো উৎসর্গ করা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, এই আলো পৌঁছে যায় পিতৃলোকে — এবং তাঁরা আশীর্বাদ করেন পরিবারের কল্যাণের জন্য।
চোদ্দ প্রদীপ দেওয়ার সঠিক নিয়মঃ
- সূর্যাস্তের পর, ঘরের প্রতিটি কোণে একটি করে প্রদীপ রাখুন।
- দরজা, রান্নাঘর, তুলসী তলা, বাথরুম, ছাদ — সব জায়গায় প্রদীপ রাখতে হয়।
- প্রদীপে তিলের তেল বা ঘি ব্যবহার করলে অত্যন্ত শুভ হয়।
-
প্রদীপ জ্বালানোর সময় মনে মনে বলুন —
“পিতৃভ্যো নমঃ, অশুভ শক্তি দূর হোক, শুভ শক্তি আগমন করুক।”
🌿 চোদ্দ শাক খাওয়ার রহস্য ও উপকারিতা
ভূত চতুর্দশীর আর এক অঙ্গ হলো চোদ্দ রকমের শাক খাওয়া।
এর পেছনে রয়েছে প্রকৃতির বিজ্ঞান ও আয়ুর্বেদ।
এই সময়ে ঋতু পরিবর্তন হয় — বর্ষা থেকে হেমন্তে প্রবেশ। শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে এই চোদ্দ শাক সাহায্য করে।
চোদ্দটি শাক সাধারণত এইগুলো হতে পারে —
- পলতা
- নটে
- হিংচে
- মেথি
- সজনে পাতা
- কলমি
- শুষনি
- শাক পুই
- গিমা
- লাউ পাতা
- কচুশাক
- ধনে পাতা
- সর্ষে শাক
- তুলসী পাতা
এই শাকগুলি একসঙ্গে সিদ্ধ করে সামান্য লবণ দিয়ে খেলে শরীর শুদ্ধ হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং পিতৃশান্তি লাভ হয়।
🥗 নিরামিষ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা
এই দিনটি কালীপুজোর আগের দিন, তাই এটি একটি পবিত্র তিথি।
তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে —
“চতুর্দশ্যাং নিষিদ্ধ মাংস, কালীপূর্বে শান্তিপ্রদম।”
অর্থাৎ, এই দিনে মাংস ভোজন অশুভ শক্তিকে আহ্বান করে। তাই নিরামিষ আহার করা অত্যন্ত জরুরি।
এই দিন খেতে হয় —
- চোদ্দ শাক
- খিচুড়ি
- বেগুন ভাজা
- চাটনি
- দই ও মিষ্টি
এভাবে নিরামিষ আহার গ্রহণ করলে ঘরের নেতিবাচক শক্তি দূর হয় এবং মন শান্ত থাকে।
🔱 বিশেষ টোটকা ও করণীয়
- ঘোড়ার নাল — বাড়ির প্রধান দরজার উপরে ঘোড়ার নাল লাগান। অশুভ শক্তি দূরে থাকবে।
- তুলসী ও গাঁদা গাছ — দরজার দুই পাশে রাখলে ঘরে শুভ শক্তি প্রবেশ করে।
- স্বস্তিক চিহ্ন অঙ্কন — লাল সিঁদুর দিয়ে দরজার উপরে স্বস্তিক আঁকুন।
- হনুমান পূজা — এই দিন সকালে হনুমানজীর পুজো করলে ভয়, ভূতপ্রেত ও নেতিবাচক প্রভাব দূর হয়।
- গঙ্গাজল ছিটানো — সন্ধ্যায় ঘরের প্রতিটি কোণে গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিন। এতে স্থায়ী শুভ শক্তি বাসা বাঁধে।
- কালো তিল দান — সন্ধ্যায় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কালো তিল ও জল অর্পণ করুন।
- রুদ্রাক্ষ ধারণ — এই দিনে রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
🌑 শাস্ত্রীয় তাৎপর্য
স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে —
“চতুর্দশ্যাং প্রদীপানং ভূতপিশাচ নাশনম।”
অর্থাৎ, ভূত চতুর্দশীর দিনে প্রদীপ জ্বালালে সমস্ত অশুভ আত্মা দূর হয়।
এই দিনটি হলো আলো ও অন্ধকারের সংঘর্ষের দিন, যেখানে মানুষ নিজের অন্তরের আলো জ্বালিয়ে ভয় ও অশুভতার উপর জয় লাভ করে।
ভূত চতুর্দশী মানে শুধু একটা প্রথা নয় — এটি হলো আত্মার পরিশুদ্ধি, শরীরের সুস্থতা, আর ঘরের শুভশক্তি জাগ্রত করার এক মহাযজ্ঞ।
এই দিন নিয়ম মেনে চোদ্দ শাক খান, চোদ্দ প্রদীপ জ্বালান, হনুমানজীর নাম স্মরণ করুন — দেখবেন জীবনের সমস্ত অন্ধকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। 🌟