দুর্গাপুজো বাঙালির আবেগ, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন তান্ত্রিক, বৈদিক এবং বাস্তুতত্ত্বের বহু গোপন নিয়ম। শুধু আনন্দ, আলো, এবং নতুন জামাকাপড়েই দুর্গোৎসব শেষ হয়ে যায় না—এ সময় কিছু প্রতীকী বস্তু ঘরে আনলে বিশ্বাস করা হয় জীবনের পথ খুলে যায়, অর্থভাগ্য জ্বলে ওঠে এবং অশুভ শক্তি দূরে সরে যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এ সব বস্তু কেনা নিয়ে মতভেদও রয়েছে—অনেকে এগুলোকে নিছক কুসংস্কার বললেও, বাস্তুশাস্ত্র ও তন্ত্রমতে এগুলো শক্তিশালী শুভচিহ্ন।
১. কলস
প্রাচীন শাস্ত্রে কলসকে “পূর্ণতার প্রতীক” বলা হয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় নতুন কলস ঘরে আনা মানেই শুভ শক্তি আমন্ত্রণ। তামা, কাঁসা বা রুপোর কলস সবচেয়ে উত্তম। কলসে জল ভরে আমপাতা ও নারকেল রাখলে তা হয়ে ওঠে মায়ের আশীর্বাদের আসন। অনেক তান্ত্রিক মতে, নতুন কলস না আনা মানেই পূজার অর্ধেক অপূর্ণ থেকে যাওয়া।
২. মা দুর্গার মূর্তি বা ছবি
দেবীর আগমন মানেই নতুন শক্তির সঞ্চার। দেবীপক্ষে ঘরে মায়ের মূর্তি আনা শুধু সাজসজ্জা নয়, বরং বিশ্বাস করা হয়, এতে পরিবার থেকে অসুরশক্তি বিদায় নেয়। তবে শর্ত আছে—মূর্তি বা ছবি উত্তর-পূর্ব কোণে রাখতে হবে, না হলে ফল উল্টে যেতে পারে।
৩. দেবীর পায়ের ছাপ
আলপনার মতো দেখতে এই প্রতীক ঘরে রাখা মানেই দেবীকে আহ্বান করা। কিন্তু ভুলভাবে মেঝেতে ফেলে রাখলে তার ফল নাকি ভয়ঙ্কর হতে পারে—অনেক পণ্ডিত বলেন, এতে পরিবারের আর্থিক ভঙ্গুরতা তৈরি হয়। তাই সর্বদা উঁচু জায়গায়, পুজোর আসনে রাখা উচিত।
৪. শ্রীযন্ত্র
এটি শুধু যন্ত্র নয়, এটি শক্তির প্রতীক। দুর্গাপুজোর দিন শ্রীযন্ত্র ঘরে আনা মানেই আয়ের দরজা খোলা। তান্ত্রিক গ্রন্থে একে “অর্থলক্ষ্মী যন্ত্র” বলা হয়েছে। অনেক পরিবার জানেই না, শ্রীযন্ত্র ঘরে না থাকলে অর্থসঙ্কট লেগেই থাকে।
৫. লাল পতাকা
দেবীপক্ষের প্রথম দিনে লাল পতাকা কিনে ঘরে রাখা মানে মায়ের বাহনকে ডাক দেওয়া। নবমীর দিন পতাকাটি মন্দিরে দান করা হলে বলা হয়, দেবী নিজে অশুভ শক্তি দূর করে দেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি—অনেক ব্যবসায়ী প্রতি বছর এই রীতি মেনে চলেন।
শুধু পাঁচটি নয়—এই অতিরিক্ত ছয়টি জিনিসও ঘরে আনুন
৬. শঙ্খ
শঙ্খকে বিষ্ণুর প্রতীক বলা হলেও, দেবী দুর্গার পূজায় শঙ্খ বাজানো মানেই অসুর শক্তির বিনাশ। দুর্গাপুজোর সময় নতুন শঙ্খ কিনে ঘরে আনলে বিশ্বাস করা হয়, ঘরে শ্রীবৃদ্ধি ও শান্তি আসে। তবে ভাঙা শঙ্খ ঘরে রাখা মারাত্মক অশুভ।
৭. গোমতি চক্র
শাস্ত্রমতে গোমতি নদীতে পাওয়া এই শঙ্খ-চক্র অদ্ভুত রত্নশক্তির অধিকারী। দুর্গাপুজোর সময় এটিকে ঘরে রাখলে সংসারে অশান্তি কমে ও ধনভাগ্য বৃদ্ধি পায়। বহু ব্যবসায়ী লুকিয়ে এই চক্র নিজের দোকানে রাখেন।
৮. আখের গাছ
গ্রামে আজও বিশ্বাস করা হয় দুর্গাপুজোর সময় আখের ডাল ঘরে আনা মানেই সমৃদ্ধি আসবে। আখ দেবীর প্রিয়, তাই দেবী যেখানে আখ থাকে সেখানেই সুখ সমৃদ্ধি আনেন।
৯. আমপাতা
কলস ছাড়া দেবীপূজা অসম্পূর্ণ। কিন্তু সেই কলসকে শক্তিশালী করে আমপাতা। দুর্গাপুজোর দিন নতুন আমপাতা ঘরে না আনা মানেই কলস অর্ধেক শক্তিহীন। অনেকেই এটি খেয়ালই করেন না।
১০. ঝাড়বাতি বা নতুন আলো
অন্ধকার দেবী সহ্য করেন না। তাই দুর্গাপুজোর দিন নতুন আলো বা ঝাড়বাতি ঘরে আনা অত্যন্ত শুভ। এতে ঘরে আলো বাড়ে এবং মানসিক অন্ধকারও দূর হয়।
১১. মহিষাসুর মর্দিনী চিত্র
দেবীর এই ভঙ্গি শুধু শিল্প নয়—এটি শক্তির প্রতীক। দুর্গাপুজোর সময় মহিষাসুর মর্দিনীর ছবি ঘরে আনলে বিশ্বাস করা হয়, পরিবারের শত্রু শক্তি পরাস্ত হয়।
বিতর্ক কোথায়?
সমস্যা হল—অনেক আধুনিক মানুষ এগুলোকে নিছক বাজারজাত কুসংস্কার বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গাপুজোর আবেগকে কাজে লাগিয়ে এইসব সামগ্রী বিক্রি করেন। কিন্তু বাস্তুশাস্ত্র ও তান্ত্রিক গ্রন্থ ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রতিটি জিনিসের পেছনে প্রাচীন আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রশ্ন হল—আমরা কি কুসংস্কার বিশ্বাস করব, নাকি এই প্রতীকের আধ্যাত্মিক শক্তিকে গুরুত্ব দেব?
উপসংহার
দুর্গাপুজো মানে শুধু নতুন জামাকাপড় বা ভোগ নয়, এটি ঘরে শুভশক্তি ডাকার এক সোনালি সুযোগ। কলস থেকে শ্রীযন্ত্র, শঙ্খ থেকে পতাকা—প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সৌভাগ্যের রহস্য। বিশ্বাসীরা মানেন—এই নিয়ম মানলে জীবন পাল্টায়, আর অবিশ্বাসীরা একে ঠেলে দেন কুসংস্কারের ঝুড়িতে। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিশ্বাস বাঙালির পূজোকে শুধু উৎসব নয়, বরং এক রহস্যময় আচার বানিয়ে তুলেছে।
—Asian Top 10 Astrologer Sri Joydeb Sastri