এই সপ্তাহেই ঘটতে চলেছে বছরের শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ।
৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার রাত ৮টা ৫৭ মিনিটে শুরু হবে এই বিরল পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। ভারতের আকাশে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রহণটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান থাকবে। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, এমন পূর্ণগ্রাস গ্রহণের প্রভাব কেবল প্রকৃতিতেই নয়, মানুষের শরীর, মন, ভাগ্য ও সংসারজীবনেও গভীরভাবে পড়ে।
তবে এখানে বিতর্কও কম নয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, চন্দ্রগ্রহণ কেবলই একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে — এর বাইরে কিছু নয়। কিন্তু প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র, অথর্ববেদ, এবং বৃহৎ জাতক বলছে, গ্রহণকালে রাহু-কেতুর ছায়াশক্তি পৃথিবীতে প্রবলভাবে সক্রিয় হয়, যার প্রভাব পড়ে প্রতিটি জীবের উপর। এই সময়ই সূক্ষ্ম অশুভ শক্তিগুলির প্রভাব সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়, তাই সুতককাল এবং গ্রহণকালীন নিয়ম মেনে চলা একান্ত প্রয়োজনীয়।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই চন্দ্রগ্রহণ?
চন্দ্রগ্রহণ তখনই ঘটে, যখন সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্র একই সরলরেখায় এসে দাঁড়ায়।
যেহেতু পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ ঘটছে, অর্থাৎ চাঁদ সম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর ছায়ায় ঢেকে যাবে, তাই এর প্রভাব স্বাভাবিকের চেয়ে বহু গুণ বেশি হবে।
শাস্ত্রমতে, এই সময়ে রাহু ও কেতু-র প্রভাব সর্বোচ্চ সীমায় থাকে। প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থ কুলার্ণব তন্ত্র অনুসারে, “গ্রহণকালে আকাশে দেবশক্তির স্থানে ছায়াশক্তির প্রাধান্য বিস্তার ঘটে।”
ফলত, এই সময়ে ভুল কাজ করলে, কেবল আধ্যাত্মিক ক্ষতিই নয়, জীবনে দুর্ভাগ্য, দাম্পত্যক্লেশ, অর্থহানি এবং রোগশোকের সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
সুতককাল: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
শাস্ত্রমতে, গ্রহণ শুরুর ন’ঘণ্টা আগে থেকেই শুরু হয় সুতককাল।
এই বছর ৭ই সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৫৭ মিনিটে গ্রহণ শুরু হবে, অর্থাৎ দুপুর ১১টা ৫৭ মিনিট থেকেই সুতক শুরু হবে।
এই সময়কাল চলবে গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
কেন সুতককে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়?
তন্ত্রশাস্ত্র মতে, সুতককালে চন্দ্রের চুম্বকীয় শক্তি অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত হয়, যা মানুষের মন, শরীর ও চক্রশক্তির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই সময়ে শরীর, মন, খাদ্য ও পরিবেশকে শুদ্ধ রাখা অপরিহার্য।
গ্রহণকালে কী কী করবেন না — নিষিদ্ধ কাজের তালিকা
শাস্ত্র ও তন্ত্রজ্ঞান অনুযায়ী, নিচের কাজগুলি গ্রহণ ও সুতককালে করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ:
১. মন্দিরে প্রবেশ ও পূজা নিষিদ্ধ
- এই সময়ে মন্দিরের দরজা সাধারণত বন্ধ রাখা হয়।
- মূর্তির উপর অশুভ শক্তির প্রভাব পড়তে পারে বলে পূজা ও আরতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
- গ্রহণ শেষে গঙ্গাজল দিয়ে ঠাকুরের আসন, মূর্তি ও পূজাস্থল শুদ্ধিকরণ করে পুনরায় পূজা শুরু করতে হবে।
২. রান্না ও খাদ্য স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন
- সুতককাল শুরু হওয়ার আগে সমস্ত খাবার রান্না করে রাখতে হবে।
- রান্না করা খাবার ও পানীয় তুলসীপাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
- গ্রহণ শেষ হলে সেই তুলসীপাতা সরিয়ে ফেলতে হবে।
- গ্রহণ চলাকালে নতুন করে রান্না বা খাদ্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।
৩. সবজি, ফল ও দুধ কাটা নিষিদ্ধ
- শাস্ত্র মতে, গ্রহণকালে জীবনীশক্তির কম্পন দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
- তাই সবজি, ফল, দুধ ও শস্য কাটা বা প্রক্রিয়াজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- এই সময়ে রান্নাঘর পরিষ্কার ও সুরক্ষিত রাখা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৪. শারীরিক সম্পর্ক ও লালসা থেকে বিরত থাকুন
তন্ত্রশাস্ত্র বলছে, গ্রহণকালে মানুষের জীবনীশক্তি ও অরা ফিল্ড দুর্বল হয়ে পড়ে।
- এই সময়ে দাম্পত্য সম্পর্ক বা কোনও ধরনের লালসাজনিত কাজ করলে, পরবর্তীতে দাম্পত্য সমস্যা, স্বাস্থ্যক্ষয় ও মানসিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
৫. গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিশেষ সতর্কতা
গর্ভস্থ শিশুর উপর গ্রহণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
- গর্ভবতী মহিলাদের এই সময় তীক্ষ্ণ বস্তু ব্যবহার, সবজি কাটা বা বাইরে বেরোনো এড়িয়ে চলা উচিত।
- শাস্ত্র মতে, গ্রহণকালে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
৬. দেহে ও মনের শুদ্ধতা বজায় রাখুন
- গ্রহণকালে ধ্যান, মন্ত্রজপ ও প্রার্থনা সবচেয়ে শুভ।
- “ওঁ নমঃ শিবায়” অথবা “ওঁ নমো নারায়ণায়” জপ গ্রহণের অশুভ প্রভাব হ্রাস করে।
- গ্রহণ শেষ হলে স্নান, দান ও জপ বিশেষভাবে ফলপ্রদ।
গ্রহণ-পরবর্তী করণীয়
গ্রহণ শেষ হওয়ার পর অবশ্যই নিম্নলিখিত কাজগুলি করা উচিত:
- গঙ্গাজল মিশ্রিত স্নান করে শরীর ও মনকে শুদ্ধ করা।
- পূজাস্থল, মূর্তি ও গৃহের প্রতিটি কোণ গঙ্গাজল বা গো-মূত্র দিয়ে পরিষ্কার করা।
- বিশেষত এই সময়ে দান করা মহাফলদায়ক — অন্ন, বস্ত্র, স্বর্ণ, রূপা বা তিল দান করলে রাহু-কেতুর দোষ প্রশমিত হয়।
জ্যোতিষীয় সতর্কবার্তা — কারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবেন
এই পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ বিশেষত মীন, কন্যা, ধনু, মকর ও বৃশ্চিক রাশির জাতকদের উপর তীব্র প্রভাব ফেলবে।
- হঠাৎ আর্থিক ক্ষতি
- দাম্পত্য জীবনে উত্তেজনা
- স্বাস্থ্য সমস্যা
- মানসিক অস্থিরতা
অন্যদিকে, বৃষ, কর্কট ও সিংহ রাশির জাতকরা এই সময়ে কিছু শুভ ফলও পেতে পারেন, যদি সঠিক প্রতিকার মেনে চলা হয়।
শ্রী জয়দেব শাস্ত্রীর গোপন টিপস (Tantrik-based Special Remedy)
এই চন্দ্রগ্রহণে বিশেষত যাঁদের উপর রাহু-কেতু দোষ প্রবল, তাঁদের জন্য:
- গ্রহণ চলাকালে কালো তিল হাতে নিয়ে “ওঁ রাহবে নমঃ” ১০৮ বার জপ করুন।
- গ্রহণ শেষে সেই তিল গঙ্গায় বা প্রবাহমান জলে দান করুন।
- এটি দুর্ভাগ্য, অসুস্থতা ও আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
শেষ কথা
চন্দ্রগ্রহণ কেবলই একটি মহাজাগতিক ঘটনা নয়, বরং মানুষের মন, ভাগ্য ও জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এক শক্তিশালী আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া।
প্রাচীন শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চললে যেখানে শুভফল লাভ সম্ভব, সেখানে অবহেলা করলে জীবনে অশান্তি, অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্যও আমন্ত্রণ পেতে পারে।
টোটকাঃ সমস্ত রাশির জন্য
১. মেষ রাশি (Aries)
প্রভাব: মানসিক অস্থিরতা, কর্মসংকট, আত্মবিশ্বাসের ক্ষয়।
টোটকা:
- গ্রহণকালীন সময়ে ১০৮ বার “ওঁ রাহবে নমঃ” জপ করুন কালো তিল হাতে।
- কালো মণি বা ওঁমুক্ত তন্ত্রমুদ্রা নিজের কাছে রাখুন।
- গ্রহণশেষে কালো তিল দান করলে মানসিক শান্তি ও ভাগ্যশক্তি বৃদ্ধি পায়।
২. বৃষ রাশি (Taurus)
প্রভাব: আর্থিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্য সমস্যা।
টোটকা:
- সুতককাল শুরু হওয়ার আগে তুলসীপাতায় জলের মধ্যে ৫টি তিল রাখুন এবং গ্রহণশেষে সেই জলের সাথে দান করুন।
- হলুদ বা সোনার মুদ্রা ঘরে রাখলে অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- মানসিক শান্তির জন্য ১১ বার “ওঁ নমো নারায়ণায়” জপ করুন।
৩. মিথুন রাশি (Gemini)
প্রভাব: সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা, বিতর্ক।
টোটকা:
- গ্রহণকালীন সময়ে সাদা চন্দন ও লাল ফুল মণ্ডপে রেখে প্রার্থনা করুন।
- ৭ বার “ওঁ শ্রী গনেশায় নমঃ” জপ করলে সম্পর্ক সুস্থ থাকে।
- গ্রহণশেষে সাদা চন্দন দিয়ে মন্দির/প্রতিমা শুদ্ধিকরণ করুন।
৪. কর্কট রাশি (Cancer)
প্রভাব: মানসিক চাপ ও পরিবারের অশান্তি।
টোটকা:
- গ্রহণকালীন সময়ে লবঙ্গ বা শুকনো তিল হাতে নিয়ে ১১ বার জপ করুন।
- ঘরের পূর্বমুখে লাল বা কমলা ফুল রাখুন।
- গ্রহণশেষে পানিতে তুলসীপাতা ভাসিয়ে দান করলে মানসিক শান্তি বৃদ্ধি পায়।
৫. সিংহ রাশি (Leo)
প্রভাব: স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাসে হ্রাস।
টোটকা:
- সুতককাল শুরু হলে ১০৮ বার “ওঁ সৌরায় নমঃ” জপ করুন।
- সোনার ছোট আংটি বা লাল রঙের বস্ত্র ঘরে রাখুন।
- গ্রহণশেষে সূর্যের দিকে ৫ মিনিট প্রণাম ও ধ্যান করুন।
৬. কন্যা রাশি (Virgo)
প্রভাব: কর্মসংকট, মানসিক ক্লান্তি, প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা।
টোটকা:
- কালো তিল দিয়ে ১১ বার “ওঁ রাহবে নমঃ” জপ।
- কালো মণি বা কেতু নক্ষত্রমুদ্রা ঘরে রাখুন।
- গ্রহণশেষে কালো তিল বা ধান দান করলে কর্মে সফলতা বৃদ্ধি পায়।
৭. তুলা রাশি (Libra)
প্রভাব: সম্পর্কের অশান্তি, অর্থনৈতিক ক্ষতি।
টোটকা:
- সুতককাল শুরু হলে তুলসী ও লাল ফুল রেখে ৭ বার “ওঁ নমো নারায়ণায়” জপ।
- গ্রহণশেষে তুলসীপাতা গঙ্গায় দান করুন।
- ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে সোনার মুদ্রা রাখলে ভাগ্য বৃদ্ধি পায়।
৮. বৃশ্চিক রাশি (Scorpio)
প্রভাব: মানসিক চাপ, রোগ-শোক, অশান্তি।
টোটকা:
- কালো তিল হাতে নিয়ে ১১ বার “ওঁ রাহবে নমঃ” জপ।
- ঘরের উত্তর-পূর্ব দিকে লবঙ্গ ও চন্দন রাখুন।
- গ্রহণশেষে কালো তিল/লবঙ্গ দান করলে রোগশোক হ্রাস পায়।
৯. ধনু রাশি (Sagittarius)
প্রভাব: মানসিক অস্থিরতা, কর্মে ব্যর্থতা।
টোটকা:
- সুতককাল থেকে গ্রহণশেষ পর্যন্ত ১০৮ বার “ওঁ ধনুরায় নমঃ” জপ।
- হলুদ বা কমলা রঙের কাপড় ঘরে রাখুন।
- গ্রহণশেষে ধ্যান ও স্নান করলে মানসিক শান্তি বৃদ্ধি পায়।
১০. মকর রাশি (Capricorn)
প্রভাব: আর্থিক ক্ষতি, দাম্পত্য সমস্যা।
টোটকা:
- কালো তিল ও লবঙ্গ হাতে নিয়ে ১১ বার জপ।
- ঘরের দক্ষিণ-পূর্বে সোনার মুদ্রা বা লাল কাপড় রাখুন।
- গ্রহণশেষে দান করলে আর্থিক ক্ষতি হ্রাস পায়।
১১. কুম্ভ রাশি (Aquarius)
প্রভাব: স্বাস্থ্য ও কর্মসংকট।
টোটকা:
- সুতককাল শুরুতে ৭ বার “ওঁ নমো নারায়ণায়” জপ।
- ঘরে লাল বা কমলা ফুল রাখুন।
- গ্রহণশেষে গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
১২. মীন রাশি (Pisces)
প্রভাব: অপ্রত্যাশিত সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
টোটকা:
- কালো তিল নিয়ে ১০৮ বার “ওঁ রাহবে নমঃ” জপ।
- গ্রহণকালীন সময়ে কেতু নক্ষত্রমুদ্রা নিজের কাছে রাখুন।
- গ্রহণশেষে কালো তিল দান করলে দুর্ভাগ্য ও অশুভ প্রভাব কমে।
বিশেষ নির্দেশনা
- টোটকাগুলো গ্রহণকালীন সুতককাল থেকে শুরু করে গ্রহণশেষ পর্যন্ত মেনে চলা উচিত।
- ঘর, আসন বা মন্দিরে ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস গ্রহণশেষে শুদ্ধিকরণ করতে হবে।
- প্রতিটি রাশির জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রজপ সংখ্যা ও উপকরণ মেনে চলা ফলপ্রদ।