রাস উৎসব বা কার্তিক পূর্ণিমা হলো বৈষ্ণব এবং শাক্ত—উভয় ধারার কাছেই এক অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ তিথি। এটি কেবল রাধাকৃষ্ণের প্রেমের লীলা বা রাস উৎসবের দিন নয়, এটি মহাজাগতিক শক্তি, আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রীয় শুভ প্রভাবের এক মহামিলন। এই পূর্ণিমা তিথি ৫ নভেম্বর, বুধবার পালিত হবে।
📅 রাস পূর্ণিমা ও তিথির সময়কাল
জ্যোতিষ মতে, যে রাতে পূর্ণিমা তিথি বিদ্যমান থাকে, সেই রাতে চন্দ্রের পূর্ণ শক্তিকে স্বাগত জানাতেই রাস উৎসব পালিত হয়। এই বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথির সূচনাকাল ও সমাপ্তিকাল নিচে উল্লেখ করা হলো:
| বিবরণ | বাংলা তারিখ | ইংরেজি তারিখ | সময় (আনুমানিক) |
| পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ | ১৮ কার্তিক, মঙ্গলবার | ৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার | রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে |
| পূর্ণিমা তিথি শেষ | ১৯ কার্তিক, বুধবার | ৫ নভেম্বর, বুধবার | সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে ৭টার মধ্যে |
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: যেহেতু পূর্ণিমা তিথির বেশিরভাগ অংশ ৫ নভেম্বর জুড়ে থাকছে, তাই মূল পূজা ও উৎসব ঐ দিনই পালিত হবে।
🌌 কার্তিক পূর্ণিমার জ্যোতিষ ও মহাজাগতিক তাৎপর্য
কার্তিক পূর্ণিমাকে জ্যোতিষশাস্ত্রে পুণ্য অর্জনের জন্য শ্রেষ্ঠ তিথি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দিনের মহাজাগতিক সংমিশ্রণগুলি মানব জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে:
১. চন্দ্রশক্তির সর্বোচ্চ প্রভাব ও মনঃশান্তি
- চন্দ্র: জ্যোতিষ মতে চন্দ্র হলেন মন, অনুভূতি এবং হৃদয়ের কারক গ্রহ। কার্তিক পূর্ণিমার রাতে চন্দ্র তার সম্পূর্ণ ষোল কলায় পরিপূর্ণ থাকে। এই সময়ে চন্দ্রশক্তির প্রভাবে মানসিক অস্থিরতা দূর হয় এবং অন্তর্দৃষ্টি (Intuition) বৃদ্ধি পায়।
- প্রতিকার: এই পূর্ণিমার রাতে চাঁদকে জল অর্ঘ্য নিবেদন করলে জন্মছকে চন্দ্রের দুর্বলতা দূর হয় এবং পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে।

২. গ্রহের আশীর্বাদ এবং কর্মফল মুক্তি
- কার্তিক মাসটি প্রধানত ভগবান বিষ্ণুর আরাধনার জন্য সমর্পিত। এই দিনে বিষ্ণুর পূজা করলে তাঁর প্রতীকী গ্রহ বুধ (বুদ্ধি ও জ্ঞান) এবং দেবী লক্ষ্মীর প্রতীকী গ্রহ শুক্র (ধন ও ঐশ্বর্য) শক্তিশালী হয়।
- এই তিথিতে গঙ্গাস্নান বা পবিত্র নদীতে স্নান করাকে 'মহা কার্তিকী স্নান' বলা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই স্নান পূর্বজন্মের এবং বর্তমানের সঞ্চিত কর্মফল বা পাপ হ্রাস করে।
৩. মঙ্গলের ওপর শুভ শক্তির বিজয়
- এই পূর্ণিমা 'ত্রিপুরারি পূর্ণিমা' নামেও পরিচিত, কারণ এই দিনে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুরকে বধ করে পৃথিবীর মঙ্গলের ওপর মন্দের পরাজয় নিশ্চিত করেছিলেন। এটি ত্রিত্ব শক্তি (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব) এবং গ্রহরাজ্য-এর মধ্যে ঐক্যের প্রতীক।
- জ্যোতিষ প্রতিকার: যারা জীবনে বারবার বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তারা এই দিনে শিবের 'ত্রিপুরান্তক' রূপের পূজা করে শুভ শক্তির বিজয় প্রার্থনা করলে বাধা দূর হয়।
🕉️ রাসযাত্রা ও কার্তিক পূর্ণিমার পালনীয় আচার (Rituals and Remedies)
জ্যোতিষশাস্ত্র এবং পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, কার্তিক পূর্ণিমার দিনে কিছু বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান পালন করলে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফলতা আসে:
১. দান ও ধর্মকর্ম (Charity and Virtue)
- দীপদান: এটি এই তিথির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার। মন্দির, নদীর ঘাট, বা তুলসী মঞ্চের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপদান করলে মোক্ষলাভ হয় এবং ঋণমুক্তি ঘটে।
- দান: এই দিনে অন্ন, বস্ত্র, ফল ও খাদ্যশস্য দরিদ্র ও ব্রাহ্মণদের দান করা দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল দেয় বলে মনে করা হয়।
২. পূজা ও উপবাস
- পূজা: এই দিনে রাধাকৃষ্ণ, বিষ্ণু-লক্ষ্মী এবং ভগবান শিবের (ত্রিপুরারি রূপে) পূজা করা হয়।
- উপবাস: কার্তিক পূর্ণিমার ব্রত পালন করলে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল লাভ হয় এবং মা লক্ষ্মী প্রসন্ন হন।
- তুলসী পূজা: কার্তিক মাসে তুলসী গাছের পূজা ও প্রদক্ষিণ অকাল মৃত্যুর ভয় দূর করে এবং পারিবারিক শান্তি আনে।
৩. আধ্যাত্মিক অনুশীলন
- মন্ত্র জপ: এই দিনে বিষ্ণু সহস্রনাম, শ্রীকৃষ্ণের মন্ত্র ("হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে") অথবা শিবের মন্ত্র ("ওঁ নমঃ শিবায়") জপ করলে আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- অশ্বত্থ গাছে জল: পূর্ণিমার দিনে মা লক্ষ্মী অশ্বত্থ গাছে অধিষ্ঠান করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। দুধে চিনি মিশিয়ে অশ্বত্থ গাছে নিবেদন করলে আর্থিক সংকট দূর হয়।
৪. রাসের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
রাস উৎসবের মূল উপাখ্যান হলো— গোপিনীরা যখন অহংপূর্ণ হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে নিজেদের মনে করেছিলেন, তখন কৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে অন্তর্হিত হন। গোপিনীদের অহং চূর্ণ হলে, শ্রীকৃষ্ণ ফিরে এসে প্রত্যেক গোপিনীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। এর অর্থ হলো, পরমাত্মার (শ্রীকৃষ্ণ) সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য জীবাত্মার (গোপিনী) হৃদয়ের অহংকার সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা আবশ্যক।