Skip to Content

চরক পূজা:  বাংলার মাটির গন্ধে ভেজা এক আধ্যাত্মিক লোকোৎসব

চরক পূজা, বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোকাচারভিত্তিক উৎসব। বৈশাখ মাসের শেষ দিন — চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
14 April 2025 by
চরক পূজা:  বাংলার মাটির গন্ধে ভেজা এক আধ্যাত্মিক লোকোৎসব
Joydev Sastri

🔱 চরক পূজার জীবন্ত পরিচয়ঃ বাংলার মাটির গন্ধে ভেজা এক আধ্যাত্মিক লোকোৎসব

চৈত্রের শেষ দিনটা যেন বাংলার গ্রামে-গঞ্জে অন্যরকম এক আলোড়ন তোলে। বৈশাখের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে যে দিন, সেদিনই পালিত হয় চরক পূজা—এক বিস্ময়কর, রহস্যময়, এবং ভক্তিভরা লোকাচার যা বাংলার আদি সংস্কৃতির প্রাণ।

চরক পূজা শুধু একটা পূজা নয়—এ যেন আত্মশুদ্ধির, ত্যাগের, ধৈর্যের, আর ঈশ্বরের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার প্রকাশ। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাংলার বহু প্রান্তে ঢাকের বাদ্য, গাজনের গান, ও চরকের ঘূর্ণিতে নেচে ওঠে গ্রামবাংলার মন।

📜 পুরাণ, মিথ ও লোকবিশ্বাসের 

গাঁথুনি:

চরক পূজার আদি ভিত্তি শিবতন্ত্র এবং পুরাণকথায় গভীরভাবে প্রোথিত। লোকমুখে প্রচলিত, ভোলা শিব স্বয়ং নেমে এসেছিলেন মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে। তিনি তখন ‘চরক’ রূপে ব্রত ধারণ করেন, নিজের শরীরে কষ্ট সহ্য করে মানুষের কল্যাণ কামনা করেন।

🔸 এই পূজাকে নীল পূজাও বলা হয়, কারণ এই দিনে শিবের নীলকণ্ঠ রূপের আরাধনা হয় — যেখানে তিনি সারা জগতের বিষ নিজের গলায় ধারণ করেন।

🔸 শিব-ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই ব্রত ও উপবাসের মাধ্যমে তারা রোগ-শোক থেকে মুক্তি পান, সন্তান লাভ হয়, এবং জীবনের কঠিন সংকট দূর হয়।

🛕 চরক পূজার আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির বিশদ বিবরণ:

১. সন্ন্যাসী ও গাজনের দল:

এই পূজার অন্যতম মুখ্য চরিত্র ‘সন্ন্যাসী’—যারা এক মাস ধরে কঠিন ব্রত পালন করেন, নিরামিষ আহার করেন, রাত্রে মাটিতে ঘুমান এবং নিজেদের ইন্দ্রিয়সংযমে রাখেন। তারা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে “গাজনের গান” গেয়ে ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। সেই গান কখনও হাসির, কখনও ব্যঙ্গের, আবার কখনও গা ছমছমে আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর।

২. চরক গাছ ও ভয়ঙ্কর শূলভেদনঃ

গ্রামের মাঝখানে একটি বিশাল বাঁশের গুঁড়ি স্থাপন করা হয়—এটিই চরক গাছ। এর মাথায় বেঁধে রাখা হয় দড়ি, আর সেই দড়িতে ঝুলে সন্ন্যাসীরা নিজেকে আকাশে ঘোরান। কিছু জায়গায় এখনও ‘শূলভেদন’ (দেহে বাঁশের কাঁটা প্রবেশ করানো) করা হয়—যেটা একটা ভয়ঙ্কর অথচ পবিত্র রীতির অংশ।

🔸 এই কষ্টভোগ, বলিষ্ঠতা ও আস্থা প্রকাশের মাধ্যমে তারা বিশ্বাস করেন, পাপক্ষয় হয় এবং আত্মা শুদ্ধ হয়।

🔸 অনেক সন্ন্যাসী আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটেন, কাঁটার বিছানায় শোয়েন—তারা বিশ্বাস করেন, এই ত্যাগ তাদের সংসারের দুঃখ দূর করবে।

৩. গাঁয়ের মহিলাদের নীল পূজাঃ

নারীরা শিবের উদ্দেশ্যে কলসিতে জল রেখে, পাঁঠাবলি দিয়ে, এবং নানা ফল-মূল দিয়ে বিশেষ পূজা করেন। কোথাও কোথাও মেয়েরা উপবাস করে ও শিবের সামনে গান গেয়ে মনোবাঞ্ছা পূরণের প্রার্থনা করেন।

🏞️ বাংলার বিশিষ্ট চরক মেলা ও লোকায়ত আনন্দের কেন্দ্রঃ

📍 লাভপুর, বীরভূম:

বিশাল চরক মেলা হয় এখানে। চারিদিকে ঢাক, মাদল, চাঁদমালার আলো, এবং রঙিন লোকনৃত্যে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকা।

📍 নদীয়া, নবদ্বীপ:

চৈত্রের শেষ ক’দিন নদীয়ায় গাজনের ঝাঁক, শোভাযাত্রা, লোকগান, ছৌ নাচ এবং পুজোর রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।

📍 ডুয়ার্স, উত্তরবঙ্গ:

উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষরা জমিয়ে এই পূজা পালন করেন। লোকগানে মিশে থাকে বনভূমির গল্প, পাহাড়ি নদীর সুর।

📍 হুগলি, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া:

টেরাকোটা মন্দিরের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে লোক সংস্কৃতির আলোক। ছৌ নৃত্য, বাঁশের নাট্যমঞ্চে গাজনের গীত—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত সংস্কৃতির কার্নিভাল।

🔮 অদ্ভুত, মজার ও মানবিক কিছু দিকঃ

🔸 এখন অনেক জায়গায় "রক্তপাতহীন চরক" পালন করা হয়, যেখানে প্রতীকী চরকে চড়া হয়—কিন্তু ভক্তির তীব্রতা আগের মতোই।

🔸 গ্রামের মানুষ এই উৎসবকে উপলক্ষ করে বছরের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন হিসেবে পালন করেন। বাচ্চারা নতুন জামা পরে, দোকানে দোকানে মেলার ভিড় জমে।

🔸 "চরকে চড়লে" মনোবাসনা পূর্ণ হয়—এই বিশ্বাস আজও অনেক পরিবারে প্রজন্ম ধরে টিকে আছে।

🔸 চরকের গান—মাটির গন্ধে ভরা, সাধনার সুরে বোনা:

“দেহ দিলাম ভোলা বাবারে,

যন্ত্রণার বিনিময়ে শান্তি,

ত্যাগের পাথরে পায়ের ছাপ,

সেই পথে মোক্ষের ঘাঁটি।”

আধুনিক যুগে চরক পূজার রূপান্তরঃ

আজকের যুগে যেখানে প্রযুক্তি আর গ্ল্যামার ঘিরে রয়েছে সব কিছু, সেখানেও চরক পূজা তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। এখন এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বাংলার সংস্কৃতির এক জীবন্ত নিদর্শন।

অনেক জায়গায় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নাট্য, লোকসংগীত, আলোকসজ্জা, ফোকফেস্ট-এর আয়োজন হয়। শহরেও ‘চরক উৎসব’ আয়োজন করে বাংলা সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়।

🪔 উপসংহারঃ

চরক পূজা একদিনের উৎসব নয়—এ এক চেতনার জার্নি। বাংলার মাটি, তার কৃষিনির্ভর সমাজ, তার ভক্তিভাবনা, ও লোকজ ঐতিহ্য মিলিয়ে এটি এমন এক উৎসব, যেটা মানুষের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাকেও নাড়িয়ে দেয়। এটি এমন এক সম্প্রীতির মেলা, যেখানে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি থাকে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি।

🌿 চরক পূজা আমাদের শিখিয়ে দেয়—আত্মত্যাগ, ধৈর্য, এবং বিশ্বাসের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এক নতুন জীবনের আশা। 🌿

📌 আপনার এলাকায় কি এখনো চরক পূজা বা গাজনের অনুষ্ঠান হয়? ছোটবেলার কোনো চরক মেলার স্মৃতি মনে পড়ে?

👇 কমেন্টে জানিয়ে দিন — আমরা শুনতে চাই আপনার কাহিনি!

📸 শেয়ার করুন এই পোস্টটি যদি আপনি চান বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকউৎসবগুলো নতুন প্রজন্ম জানুক, ভালোবাসুক।

#চরকপূজা #গাজন #বাংলারঐতিহ্য #লোকসংস্কৃতি #ভোলা_বাবা_কি_জয়

চরক পূজা:  বাংলার মাটির গন্ধে ভেজা এক আধ্যাত্মিক লোকোৎসব
Joydev Sastri 14 April 2025
Share this post
Tags
Archive