আংটি পরা আমাদের সভ্যতার বহু প্রাচীন একটি সংস্কৃতি। শুধু সাজসজ্জা নয়, বহু ধর্ম, শাস্ত্র ও গূঢ় তন্ত্রবিদ্যায় আংটি ধারণের পেছনে রয়েছে এক গভীরতর রহস্য। হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র, তন্ত্রশাস্ত্র, এমনকি প্রাচীন বৈদিক দর্শন বলছে—মানব শরীরের প্রতিটি আঙুল এক একটি বিশেষ গ্রহ ও শক্তির বাহক। আবার প্রতিটি ধাতু বা রত্নের সঙ্গেও যুক্ত থাকে মহাজাগতিক শক্তির নির্দিষ্ট কম্পন। ভুল ধাতু বা রত্ন ভুল আঙুলে পরা মানে হচ্ছে সেই মহাজাগতিক শক্তিকে বিরূপ করে তোলা—যার ফলস্বরূপ হতে পারে দুর্ঘটনা, আর্থিক ক্ষতি, রোগ, সম্পর্কের ভাঙন, এমনকি আকস্মিক মৃত্যু পর্যন্ত!
তন্ত্রশাস্ত্রে আঙুল ও রত্নের গূঢ় সম্পর্ক
তন্ত্র মতে, প্রতিটি আঙুল ‘নাড়ি শক্তি’র একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় পথে জড়িত থাকে। তন্ত্রবিদ্যার মতে, আঙুলের মাধ্যমে শুধু শক্তি নির্গত হয় না—বরং বাইরে থেকে শক্তিও গ্রহণ করে শরীরের প্রাণতন্ত্রে প্রবাহিত হয়। এই কারণে সাধকেরা আঙুলে বিশেষ ধাতুর আংটি পরে মন্ত্রসিদ্ধি, গ্রহশান্তি ও কর্মসিদ্ধির জন্য তন্ত্র ব্যবহার করেন।
প্রাচীন ‘কালিকা তন্ত্র’ ও ‘গুহ্যতন্ত্র’-এ উল্লেখ রয়েছে, “যে আঙুলে গ্রহ-বিরোধী ধাতু ধারণ করা হয়, সে ব্যক্তি চণ্ডাল শাপে আক্রান্ত হয়।” অর্থাৎ তার জীবনে দুর্ভাগ্য ও অপমৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে।
🟡 তর্জনী (Index Finger) – বৃহস্পতি ও জ্ঞানশক্তির বাহক
- প্রতিনিধি গ্রহ: বৃহস্পতি (Guru)
- ধাতু: সোনা, পোখরাজ
- রত্ন: হীরা, নীলা, প্রবাল
- তান্ত্রিক বিশ্বাস: তন্ত্রশাস্ত্রে তর্জনী আঙুল ধরা হয় 'জ্ঞানমুদ্রার’ অংশ হিসেবে। এই আঙুলে সোনার আংটি ধারণ করলে তপস্যা, বুদ্ধি, শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির দ্বার খুলে যায়।
-
তান্ত্রিক মন্ত্র:
“ॐ बृं बृहस्पतये नमः”
প্রতি বৃহস্পতিবার এই মন্ত্র জপ করে পোখরাজ তর্জনীতে ধারণ করলে গুরু দোষ নাশ হয়।
⚫ মধ্যমা (Middle Finger) – শনি ও কর্মফল নির্দেশক
- প্রতিনিধি গ্রহ: শনি (Shani)
- ধাতু: লোহা, রুপো
- রত্ন: নীলা, গোমেদ, স্ফটিক
- নিষিদ্ধ: সোনা—তান্ত্রিক মতে, মধ্যমাতে সোনা ধারণ করলে "মন্দ শক্তি" অনুপ্রবেশ করে।
- তান্ত্রিক উপযোগ: যারা কালসার দোষ, শনির সাড়ে সাতি বা শনির মহাদশায় কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁদের জন্য মধ্যমাতে নীলা ধারণ করা উচিত।
-
তান্ত্রিক বিধি:
শনিবার সন্ধ্যায় কুষ্ঠরোগীকে দান করার পর আংটি ধারণ করলে নীলার প্রভাব তীব্র হয়।
🔴 অনামিকা (Ring Finger) – সূর্য ও আত্মগরিমার বাহক
- প্রতিনিধি গ্রহ: সূর্য (Surya)
- ধাতু: তামা
- রত্ন: হীরা, রুবি, মুনস্টোন
- তান্ত্রিক যোগ: সূর্য তন্ত্রে বলা হয়—এই আঙুলে আংটি ধারণ মানে ‘আত্মা শক্তির উন্মোচন’। তান্ত্রিক সাধকরা রুবি ধারণ করেন এই আঙুলে, সূর্য শক্তিকে জাগ্রত করতে।
- বিশেষ উপকারিতা: রাজ্যপদ, উচ্চপদস্থ চাকরি, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি।
⚪ কনিষ্ঠা (Little Finger) – চন্দ্র ও সম্পর্কের বাহক
- প্রতিনিধি গ্রহ: চন্দ্র ও বুধ
- ধাতু: রুপো
- রত্ন: মুক্তো, পান্না
- তান্ত্রিক বিশ্বাস: যাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, মানসিক অবসাদ রয়েছে বা সংসারে সুখ নেই, তাঁদের কনিষ্ঠায় মুক্তো ধারণ করতে বলা হয়।
-
তান্ত্রিক টোটকা:
“ওঁ চন্দ্রায় নমঃ” মন্ত্র উচ্চারণ করে সোমবার রাতে রুপার আংটি ধারণ করলে চন্দ্র দোষ দূর হয়।
শত্রুনাশ ও রত্নের কার্যকারিতা বাড়াতে তান্ত্রিকভাবে আংটিকে গঙ্গাজল ও চাঁদের আলোয় ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়।
🔵 বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ (Thumb) – ইচ্ছাশক্তি ও প্রভাবের বাহক
- প্রতিনিধি শক্তি: আত্মবোধ ও আদিম শক্তি (Root Chakra)
- ধাতু: প্ল্যাটিনাম, রুপো
- রত্ন: গারনেট
- তান্ত্রিক মন্ত্রসিদ্ধি: গারনেট বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে ধারণ করলে সাধকের ‘মূলাধার’ চক্র সক্রিয় হয়। এতে জীবনে দৃঢ়তা, সাহস ও রক্ষাকবচের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- তান্ত্রিক পদ্ধতি: মঙ্গলবারে রক্তচন্দনের উপর গারনেট রেখে ‘ওঁ গার্নেতায় নমঃ’ মন্ত্র ১০৮ বার জপ করলে তা সিদ্ধ হয়।
❌ ভুল আঙুলে ভুল ধাতুর ভয়াবহ ফলাফল:
- সোনা মধ্যমায়: কোর্ট-কাচারি, পৈত্রিক ঝামেলা, শত্রু বৃদ্ধি
- লোহা তর্জনীতে: গুরু অপমান, বুদ্ধির প্রতিবন্ধকতা
- হীরা কনিষ্ঠায়: প্রেমভঙ্গ, মানসিক অস্থিরতা
- তামা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে: রাগ, হঠকারিতা বৃদ্ধি
🧘♂️ বিশেষ তান্ত্রিক টোটকা (শুধু সিদ্ধ ব্যক্তিদের জন্য):
❖ কোনও ধাতু বা রত্ন ধারণের আগে ‘পঞ্চতত্ত্ব অভিমন্ত্রণা’ করে নিতে হয়:
- আগুন: ধূপ
- জল: গঙ্গাজল
- বায়ু: ধুনো
- পৃথিবী: তুলসী পাতা
- আকাশ: মন্ত্র উচ্চারণ
❖ এরপর দেহের সংশ্লিষ্ট আঙুলে পরালে আংটির তান্ত্রিক কার্যক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যায়।
আংটি পরা কেবল স্টাইল নয়—এ এক গভীর জ্যোতিষ ও তান্ত্রিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ। আপনার জন্মকুণ্ডলীর বিশ্লেষণ, গ্রহের দশা, রাশি ও রত্ন মিলিয়ে সঠিক আঙুলে সঠিক ধাতু পরলে তবেই আপনি পেতে পারেন সত্যিকারের সুফল। নতুবা অজান্তেই জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারেন।
📣 আপনার জন্য প্রশ্ন:
আপনি কী সঠিক আঙুলে সঠিক আংটি পরেছেন? নাকি ভুল আঙুলে পরেই আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যায় জর্জরিত?
কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না!