Skip to Content

মহালয়ার দিন তর্পণ ও আধ্যাত্মিক রহস্য: পূর্বপুরুষের স্মরণে এক অনন্ত যাত্রা

এশিয়ান টপ ১০ অ্যাস্ট্রোলজার শ্রী জয়দেব শাস্ত্রী
14 September 2025 by
মহালয়ার দিন তর্পণ ও আধ্যাত্মিক রহস্য: পূর্বপুরুষের স্মরণে এক অনন্ত যাত্রা
জয়দেব শাস্ত্রী । ৫১কালিবাড়ি

ভূমিকা: মহালয়ার আসল তাৎপর্য

মহালয়া নামটি উচ্চারিত হলেই বাঙালির হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন জেগে ওঠে। কারও কাছে এটি দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন, কারও কাছে এটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রেডিও সম্প্রচারের আবেগঘন সকাল। কিন্তু মহালয়ার প্রকৃত মর্ম নিহিত আছে “তর্পণ” নামক প্রাচীন বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে। এটি শুধুই একটি সামাজিক আচার নয়, বরং পূর্বপুরুষের স্মরণ, কৃতজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক যোগসূত্র এবং আমাদের জীবনের অদৃশ্য শক্তিকে সন্মান জানানোর একটি মহৎ উপায়। প্রতিটি পরিবারের ইতিহাস, প্রতিটি গোত্রের ধারাবাহিকতা এবং প্রতিটি মানুষের মানসিক ভারমুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই তর্পণ। তাই মহালয়া মানে কেবল উৎসবের সূচনা নয়, বরং আধ্যাত্মিক দায়িত্ববোধের এক চিরন্তন প্রতিফলন।

🔶 তর্পণের আদি ইতিহাস ও প্রাচীন বেদীয় ভিত্তি

“তর্পণ” শব্দের মূল অর্থ তৃপ্ত করানো। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে বারবার উল্লেখ এসেছে যে জীবিতদের কর্তব্য হলো পিতৃলোক বা পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সন্তুষ্ট করা। বেদীয় যুগের ঋষিরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের জীবন তিনটি ঋণে আবদ্ধ—দেবঋণ, ঋষিঋণ এবং পিতৃঋণ। এর মধ্যে পিতৃঋণ সর্বাধিক গুরু কারণ আমাদের জন্ম, দেহ, সংস্কার ও বংশপরম্পরা পূর্বপুরুষেরই দান। তাই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা জীবনের মূল কর্তব্য। তর্পণ সেই দায় শোধের একমাত্র পথ।

মনুস্মৃতি বলছে—“যে সন্তান পিতৃপুরুষকে তর্পণ করে না, সে জীবনে কখনো পূর্ণতা পায় না।” প্রাচীন বৈদিক যজ্ঞে তর্পণ ছিল অপরিহার্য। গৃহ্যসূত্রে নির্দেশ আছে, বিশেষত অমাবস্যা তিথিতে তর্পণ করলে পিতৃলোক প্রশান্ত হয় এবং গোত্রে শান্তি বজায় থাকে। মহালয়ার অমাবস্যা দিনটিকে তাই পিতৃত্রিপুষ্টি দিবস বলা হয়।

🔶 তর্পণের আদি ইতিহাস

বেদের “শ্রাদ্ধসূক্ত” অংশে তর্পণের বীজ নিহিত। “তৃপ্তি” শব্দ থেকেই “তর্পণ”—যা অর্থ দাঁড়ায় “তৃপ্ত করানো”। অর্থাৎ জল, তিল, কুশা ও অর্ঘ্যের মাধ্যমে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের আত্মাকে তৃপ্ত করি।

  • ঋগ্বেদীয় সূত্রে বলা হয়েছে— “পিতৃণাম প্রসন্নতায় দেবতারা সন্তুষ্ট হন, আর দেবতাদের সন্তুষ্টিতেই বিশ্বকল্যাণ ঘটে।”
  • মনুস্মৃতিগৃহ্যসূত্রে উল্লেখ আছে— মহালয়ার অমাবস্যায় তর্পণ করলে পিতৃলোকে সদগতি লাভ হয়।

🔶 কেন মহালয়ার দিন বিশেষ তাৎপর্যময়?

জ্যোতিষশাস্ত্রে মহালয়ার দিনের আকাশীয় বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্য কন্যা রাশিতে অবস্থান করে, যা হলো কর্ম, দায়িত্ব এবং জীবনের ধারাবাহিকতার প্রতীক। অপরদিকে চন্দ্র থাকে অমাবস্যার অন্ধকারে, যা হলো সমাপ্তি, শূন্যতা এবং নতুন সূচনার ইঙ্গিত। সূর্য পিতার প্রতীক, চন্দ্র মাতার প্রতীক। এই দুই শক্তি যখন মহালয়ার দিনে মিলিত হয়, তখন পৃথিবী ও পিতৃলোকের মধ্যে এক বিশেষ কম্পন সৃষ্টি হয়, যা তর্পণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

তান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, মহালয়ার অমাবস্যা হলো এমন একটি সময় যখন পিতৃশক্তি ও দেবীশক্তির সংযোগ ঘটে। তাই এই দিনেই দেবীপক্ষ শুরু হয়। অর্থাৎ আমরা পূর্বপুরুষকে স্মরণ করে, তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে দেবীকে আহ্বান করি। মহালয়া তাই একদিকে পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে দেবীর আবাহনের সেতুবন্ধন।

🔶 আধ্যাত্মিক রহস্য: পিতৃঋণ ও তর্পণের গভীরতা

মানুষ তিনটি ঋণে আবদ্ধ থাকে—দেবঋণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণ। দেবঋণ পূর্ণ হয় যজ্ঞ, পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে। ঋষিঋণ পূর্ণ হয় শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রচারের মাধ্যমে। কিন্তু পিতৃঋণ পূর্ণ হয় কেবল তর্পণ ও শ্রাদ্ধের মাধ্যমে। পিতৃঋণ হলো জন্মের ঋণ। আমাদের রক্ত, দেহ, চেতনা, সংস্কার—সবই এসেছে তাঁদের কাছ থেকে। তাই এই ঋণ শোধ না করলে জীবনের পূর্ণতা আসে না।

তর্পণ আচারটির আধ্যাত্মিক রহস্য হলো ancestral energy healing। আমরা যখন কুশা, তিল ও জলের অর্ঘ্য দিই, তখন শুধু বস্তু প্রদান করি না—আমাদের মানসিক কম্পন, কৃতজ্ঞতার অনুভূতি এবং আত্মিক শক্তি এক তরঙ্গের মতো পিতৃলোকে পৌঁছে যায়। এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক রিচার্জ বা সংযোগ, যা জীবিত ও মৃত আত্মার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। তাই তর্পণ মানে শুধু একটি রীতি নয়, বরং আত্মিক ঋণ মুক্তির পথ।

🔶 তর্পণ করার নিয়ম ও আচারবিধি

তর্পণ আচার শাস্ত্রমতে অত্যন্ত নিয়মবদ্ধ। ভোরবেলা, সূর্যোদয়ের পূর্বে নদী বা গঙ্গার তীরে দক্ষিণ মুখ করে বসা বা দাঁড়ানো শ্রেষ্ঠ। দক্ষিণ দিককে বলা হয় যমদিক, কারণ এই দিকেই পিতৃলোকের শক্তি সক্রিয় থাকে।

অর্ঘ্যে ব্যবহৃত হয় তিল, জল, কুশা ও অক্ষত। তিল হলো অমরত্বের প্রতীক, জল হলো জীবনের সারাংশ, কুশা হলো পবিত্রতার প্রতীক আর অক্ষত বা চাল হলো সমৃদ্ধি ও ধারাবাহিকতার প্রতীক। মন্ত্রোচ্চারণ করে পিতৃদের নাম ও গোত্র স্মরণ করে প্রতিবার জল অর্ঘ্য প্রদান করতে হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—“কুশাঙ্কুরেন যদ্বার্যঃ তেন পিতৃণাম তর্পণম।” অর্থাৎ কুশা-সহ জল অর্ঘ্যে পূর্বপুরুষ তৃপ্ত হন।

🔶 জ্যোতিষীয় প্রভাব ও পিতৃদোষ মুক্তি

অনেক মানুষের কুণ্ডলীতে পিতৃদোষ বা কুলদোষ থাকে, যা তাঁদের জীবনে অগ্রগতি ব্যাহত করে। নবম ভাভ (ধর্মভাব), চতুর্থ ভাভ (গৃহভাগ্য) বা অষ্টম ভাভ (পূর্বজন্ম কার্মিক ঋণ) ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পিতৃদোষ হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে সন্তানের কষ্ট, বিবাহে সমস্যা, আর্থিক অগ্রগতিতে বাধা বা মানসিক অশান্তি দেখা দেয়। মহালয়ার দিনে তর্পণ করলে এই দোষ প্রশমিত হয়।

যাদের সূর্য কুণ্ডলীতে দুর্বল, তাঁদের জীবনে পিতৃসংকট দেখা দেয়—পিতার সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হয় বা পিতার মৃত্যুজনিত ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হয়। মহালয়ার তর্পণ সেই সূর্যদোষকে প্রশমিত করে। তাই মহালয়া শুধু আধ্যাত্মিক নয়, জ্যোতিষীয় চিকিৎসাও।

🔶 সমাজ-সংস্কৃতিতে তর্পণের ভূমিকা

মহালয়ার ভোরবেলা কলকাতার গঙ্গার ঘাট থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার পুকুরপাড়—যেখানেই তাকানো যায় সেখানেই হাজার মানুষের সমবেত উপস্থিতি। ছোট থেকে বড়, ধনী থেকে গরিব—সকলেই নিজেদের বংশপরম্পরার স্মরণে গঙ্গায় তর্পণ করেন। এই সমষ্টিগত আচারের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য।

আকাশবাণীর “মহিষাসুরমর্দিনী” শোনার আবেগ যেমন বাঙালির হৃদয়ে এক সুর বেঁধে দেয়, তেমনই তর্পণের দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা সবাই এক পূর্বপুরুষের সন্তান। আমাদের অস্তিত্ব তাদের কৃপায়। তাই তর্পণ একদিকে ব্যক্তিগত আচার, অন্যদিকে সামষ্টিক সামাজিক স্মৃতি।

🔶আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আজকের প্রজন্ম অনেক সময় তর্পণকে কেবল প্রথাগত আচার হিসেবে দেখে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, তর্পণ আসলে psychological closure। আমরা যখন পূর্বপুরুষকে স্মরণ করি, তখন আমাদের অবচেতন মন সেই অপূর্ণতা, ক্ষতি বা বংশগত আঘাত থেকে মুক্তি পায়। এটি এক ধরনের ancestral healing—যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা মানসিক ভার লাঘব করে। তর্পণ হলো সেই আধ্যাত্মিক থেরাপি যা না করলে আমরা নিজেদের ভেতরে অপূর্ণ থেকে যাই।

🔶মহালয়ার অমর বার্তা

মহালয়ার তর্পণ আমাদের শেখায়—আমাদের জীবন কেবল আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টার ফসল নয়, বরং বহু প্রজন্মের আশীর্বাদ ও ত্যাগের ফল। তাই পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা করা মানে নিজেদের অস্তিত্বকে সন্মান করা। মহালয়ার তর্পণ সেই শ্রদ্ধার প্রতীক।

এটি কেবল একটি রীতি নয়; এটি আমাদের জাতিগত পরিচয়, আধ্যাত্মিক সাধনা, জ্যোতিষীয় মুক্তি এবং মানসিক শান্তির চাবিকাঠি। মহালয়া তাই শুধু দেবীপক্ষের সূচনা নয়, বরং এক অমর বার্তা—পিতৃঋণ শোধ করো, পূর্বপুরুষকে স্মরণ করো, জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনো।

✍ বিশ্লেষণ: এশিয়ান টপ ১০ অ্যাস্ট্রোলজার শ্রী জয়দেব শাস্ত্রী

মহালয়ার দিন তর্পণ ও আধ্যাত্মিক রহস্য: পূর্বপুরুষের স্মরণে এক অনন্ত যাত্রা
জয়দেব শাস্ত্রী । ৫১কালিবাড়ি 14 September 2025
Share this post
Tags
Archive