ভূমিকা
হিন্দু ধর্মে পিতৃপক্ষ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব। বৈদিক ও পুরাণোক্ত মতে, এই ১৫ দিন হল পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং তাঁদের আত্মার শান্তি প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময় মানুষ তাঁদের পিতৃপুরুষদের জল, তিল ও অন্ন নিবেদন করেন—যা “তর্পণ” নামে পরিচিত।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে—নদী ছাড়া অন্য জলাশয়ে তর্পণ করা যায় না কি? অনেকেই মনে করেন যে কেবল গঙ্গার মত পবিত্র নদীতেই তর্পণ করা উচিত। আসলে শাস্ত্রে এ বিষয়ে কিছু বিস্তৃত নিয়ম উল্লেখ আছে, যা সঠিকভাবে না মানলে তর্পণ ফলপ্রসূ হয় না বরং পূর্বপুরুষদের অসন্তুষ্টিও ডেকে আনতে পারে।
তর্পণ কোথায় করা যায়?
🔹 শাস্ত্র মতে নদী সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান – বিশেষত গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, নারায়ণী প্রভৃতি নদীতে তর্পণ সর্বাধিক পুণ্যদায়ক।
🔹 তবে নদী ছাড়া – পুকুর, সরোবর, সাগর কিংবা কূপ—সব জলাশয়েই তর্পণ করা যায়।
🔹 মূল শর্ত হল – যে স্থানে তর্পণ করবেন, সেখানে আগে স্নান করা আবশ্যক। অর্থাৎ নদী হোক বা পুকুর—সেই জলাশয়ে স্নান সেরে তবেই তর্পণ শুরু করতে হবে।
তর্পণ পালনের ধাপে ধাপে নিয়ম
তর্পণ হল অত্যন্ত শাস্ত্রসম্মত আচার। একে অবহেলায় করলে এর ফল নষ্ট হয়ে যায়। সঠিক প্রক্রিয়া নিম্নরূপ—
-
স্নান বিধি
- ভোরে উঠে স্নান করতে হবে।
- পিতৃপক্ষের তর্পণে ব্যবহৃত জলাশয়ে নিজেকেই স্নান করতে হবে।
- স্নানের পরে শরীরে বিশুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করতে হবে।
-
আসন ও দিকনির্দেশ
- জলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাভি পর্যন্ত ডুবিয়ে।
- মুখ থাকবে সর্বদা পূর্ব দিকে।
- মাটির তিলক কপালে পরিধান করা আবশ্যক।
-
কুশ ও আঙ্গুলের ব্যবহার
- ডান হাতের অনামিকা আঙুলে কুশ পরিধান করতে হয়।
- কুশ আঙ্গুলে না থাকলে তর্পণ অসম্পূর্ণ বলে ধরা হয়।
-
তর্পণের জল প্রস্তুতি
- হাতে কোশা বা পাত্র নিতে হবে।
- তাতে জল, কালো তিল, তুলসীপাতা, অক্ষত (ভাঙা নয় এমন চাল), এবং শুদ্ধ ফুল রাখা উত্তম।
- এই জলেই পূর্বপুরুষদের নাম স্মরণ করে আঞ্জলি দিতে হবে।
-
তর্পণের ক্রম
শাস্ত্র নির্দেশিত তর্পণের ধাপগুলি হলো—- দেব তর্পণ – দেবতাদের উদ্দেশ্যে।
- ঋষি তর্পণ – ঋষিদের উদ্দেশ্যে।
- মনুষ্য তর্পণ – মানবগণের উদ্দেশ্যে।
- দিব্য তর্পণ – দিব্য আত্মাদের উদ্দেশ্যে।
- যম তর্পণ – যম ও পিতৃলোকের অধিপতির উদ্দেশ্যে।
- পিতৃ তর্পণ – সর্বশেষে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তিনবার জলদান।
-
মন্ত্রোচ্চারণ
- তর্পণের সময় বিষ্ণু মন্ত্র ও পিতৃ মন্ত্র উচ্চারণ করা আবশ্যক।
- মন্ত্রবিহীন তর্পণ শুধু জল ঢালা হয়ে দাঁড়ায়, শাস্ত্রসম্মত তর্পণ হয় না।
-
প্রাকৃতিক নিয়ম
- তর্পণের জল কখনোই বৃষ্টির জলের সঙ্গে মেশানো যাবে না।
- যদি বৃষ্টি হয়, তবে মাথায় ছাতা ধরে তর্পণ করতে হবে।
মহালয়ার দিনে তর্পণের মাহাত্ম্য
পিতৃপক্ষের প্রতিটি দিনই তর্পণের জন্য যোগ্য। তবে মহালয়া অমাবস্যাকে শ্রেষ্ঠতম দিন হিসেবে ধরা হয়। কারণ এই দিনে পিতৃলোক থেকে পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীতে অবতরণ করেন বলে বিশ্বাস। সেদিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষেরা সর্বাধিক সন্তুষ্ট হন এবং তাঁদের আশীর্বাদে পরিবার সমৃদ্ধ হয়।
তর্পণের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
- তর্পণ কেবল একটি আচার নয়, এটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম।
- পূর্বপুরুষদের তুষ্ট করলে সংসারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
- তর্পণ না করলে বা ভুলভাবে করলে জীবনে পিতৃ দোষ সক্রিয় হয়, যা পরিবারে অশান্তি, আর্থিক ক্ষতি এবং বাধা-বিপত্তি ডেকে আনে।
- সঠিক তর্পণ করলে আত্মার মুক্তি ঘটে এবং পরবর্তী জন্মের শুভ গতি নিশ্চিত হয়।
তর্পণ একটি গভীর আধ্যাত্মিক আচার। এটি কেবল নদীর স্রোতে সীমাবদ্ধ নয়; শাস্ত্রসম্মতভাবে যে কোনও জলাশয়ে এটি করা যায়। কিন্তু সঠিক নিয়ম না মানলে তর্পণ বৃথা হয়। তাই প্রত্যেক ভক্তের উচিত শুদ্ধাচারে, স্নান, মন্ত্রোচ্চারণ ও ক্রমানুসারে তর্পণ সম্পাদন করা। এতে পূর্বপুরুষেরা সন্তুষ্ট হন, সংসার থেকে পিতৃ দোষ দূর হয়, এবং দেবীপক্ষের সূচনায় পরিবারে আসে নতুন শক্তি ও কল্যাণের আলো।
📌 এই বিশেষ তথ্য শেয়ার করলেন Asian Top 10 Astrologer Sri Joydeb Sastri।