বাঙালির ধর্মীয় সংস্কৃতিতে দেবী বিপত্তারিণীর পুজো এক রহস্যময় এবং গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। আষাঢ় মাসে নির্দিষ্ট বৃহস্পতিবার পালন করা এই ব্রতকে ঘিরে রয়েছে বহু শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, লোকাচার ও তান্ত্রিক বিশ্বাস। এই পুজো শুধু নারীর মঙ্গল কামনাই নয়, বরং জীবনের প্রতিটি বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার এক গুপ্ত তান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে—কেন ১৩ রকমের নৈবেদ্য? কেন হাতে বাঁধা হয় লাল তাগা? এবং এই পুজোর প্রকৃত শক্তি কোথায় নিহিত?
দেবী বিপত্তারিণী: কোন শক্তির প্রতীক?
দেবী বিপত্তারিণীকে কালী বা দুর্গার একটি রূপ হিসেবে মানা হয় যিনি জীবন থেকে "বিপদ" (বিপত্তি) দূর করেন। মূলত এই পুজোটি বিবাহিত নারীরা করে থাকেন স্বামীর মঙ্গল ও সংসারের শান্তি রক্ষার জন্য। তবে প্রকৃত অর্থে দেবী কেবল স্বামী রক্ষাকারী নন—তিনি কালের গর্ভে প্রতিটি জীবের অন্তর্নিহিত বিপর্যয়ের উৎস এবং তা থেকে মুক্তির উপায়ও।
তান্ত্রিক মতে, দেবী বিপত্তারিণী আসলে "অভয়ারূপা শাক্তশক্তি"—যিনি জীবনের দুর্ঘটনা, অকালমৃত্যু, হঠাৎ রোগ, বন্ধ্যাত্ব, দারিদ্র্য বা অপদৃষ্টির মতো শক্তিগুলিকে রোধ করেন। বিশেষ করে বৃহস্পতি, রাহু ও শনির অশুভ প্রভাবে যখন কোনো নারীর বা পুরুষের জন্মকুণ্ডলীতে সংসার জীবনে বাধা আসে, তখন এই পুজো অত্যন্ত ফলপ্রদ।
🔴 ১৩ প্রকার নৈবেদ্য: সংখ্যার আধ্যাত্মিক গাণিতিক গূঢ়তা
আমরা জানি, ১৩ সংখ্যাটিকে অনেক সংস্কৃতিতে অশুভ মনে করা হয়। কিন্তু শাস্ত্র মতে এটি “একাদশ রুদ্র + চন্দ্র ও সূর্য”—এই মিলিত শক্তিকে বোঝায়।
তন্ত্রশাস্ত্রে ১৩ মানে হলো ১২ রাশি + অতিরিক্ত "কাল" অর্থাৎ "দশম দিক"—যা সময়ের পরিধিকে ভেদ করে কাজ করতে পারে।
👉 এই ১৩ রকমের নৈবেদ্য মূলত দেবীর ১৩টি শক্তিরূপকে নিবেদন করা হয়, যেমন—
- আন্নপূর্ণা (অন্ন)
- দুর্গা (রক্ষা)
- চণ্ডিকা (বিপক্ষ বিনাশ)
- কালিকা (অশুভ বিনাশ)
- ভবানী (মাতৃরূপ)
- লক্ষ্মী (সমৃদ্ধি)
- সরস্বতী (জ্ঞানের দান)
- কামাখ্যা (কামবিজয়)
- সিদ্ধিদাত্রী (সিদ্ধি)
- ত্রিপুরসুন্দরী (সৌন্দর্য ও মায়া)
- মাতঙ্গী (মোহন শক্তি)
- ভৈরবী (তেজ)
- অভয়া (ভয়ের অভাব)
এই সমস্ত নৈবেদ্য দিয়ে দেবীকে আরাধনা করা হয় যেন তিনি জীবনের ১৩টি প্রধান বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
🔴 লাল তাগা: কেবল রীতি নয়, এক জ্যোতিষীয় প্রতিরক্ষা চক্র
অনেকেই জানেন না, বিপত্তারিণীর পুজোয় যে লাল তাগা হাতে বাঁধা হয় তা এক ধরনের তান্ত্রিক “আর্মর” বা রক্ষা কবচ।
শাস্ত্র মতে, এই তাগা আসলে "নবগ্রহ কবচ"-এর প্রতীক। বিশেষ করে মঙ্গল, রাহু ও শনির দৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে এটি অত্যন্ত কার্যকর।
- লাল রং: মঙ্গলের প্রতীক। শক্তি, সাহস, রক্ত, প্রাণশক্তির প্রতীক।
- ঘড়নের সময় মন্ত্রজপ: "ওঁ ক্রীং কালিকা-য়ৈ নমঃ" বা "ওঁ বিপত্তারিণী দেৱ্যৈ নমঃ" বললে সেই তাগার মধ্যে প্রবাহিত হয় মন্ত্রশক্তি।
- ডান হাতে বাঁধা: পুরুষ বা তৃতীয় পক্ষ থেকে রক্ষার প্রতীক।
এই তাগাটি ২১ দিন বা ৭০ দিন পর্যন্ত হাতে রাখলে মানসিক নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস অনেকগুণে বাড়ে।
🔴 ব্রতের মূল উদ্দেশ্য কী?
এই ব্রতের মূল লক্ষ্য তিনটি দিক রক্ষা করা:
- শারীরিক সুরক্ষা – রোগ, অকালমৃত্যু, দুর্ঘটনা, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি থেকে রক্ষা।
- মানসিক সুরক্ষা – মানসিক চাপ, দাম্পত্য কলহ, অভিশাপ ও কু-প্রভাব থেকে রক্ষা।
- আধ্যাত্মিক সুরক্ষা – কুগ্রহদৃষ্টি, অপদৃষ্টি, প্রেতাত্মা প্রভাব থেকে রক্ষা।
তান্ত্রিক মতে এই পুজোর সময় “সাধিকারিণী কাল” চলে, যেখানে দেবী বিশেষভাবে সক্রিয় থাকেন ও দান-প্রতিদান খুব তীব্র হয়। তাই, এই সময়ে প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত সচেতনভাবে নিতে হয়।
🔴 কী কী করলে হিতে বিপরীত হতে পারে?
১. উপবাস না রেখে পুজো করলে পাপ হয়—এই পুজো এক রকম "সংযম-তন্ত্র"।
২. লাল তাগা পরে অশুচি স্থানে যাওয়া নিষিদ্ধ—যেমন টয়লেট বা শ্মশান।
৩. পুজোর দিন রাতে ঝগড়া করলে বিপদ বাড়ে—এটি দেবীর অভিশাপ ডেকে আনতে পারে।
৪. পুজোতে ১৩ বস্তু না দিলে ব্রতের ফল অসম্পূর্ণ হয়।
৫. তাগা পরে নিয়ম না মানলে তা "সক্রিয় অভিশাপের রূপ" নেয়।
🔴 পুরুষরাও কি এই ব্রত পালন করতে পারেন?
যদিও এটি মূলত নারী কেন্দ্রিক ব্রত, তবুও বর্তমানে অনেক পুরুষ জ্যোতিষ নির্দেশে এই পুজো করেন—বিশেষ করে যদি তাদের কুণ্ডলীতে সপ্তম, অষ্টম, দ্বাদশ ঘরে রাহু-শনি-মঙ্গল অশুভ যোগ থাকে বা “কালসপ্তম যোগ” থাকে।
🔴 বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা—বিশ্বাস না অন্ধতা?
অনেকে প্রশ্ন করেন, এগুলি কি শুধুই সংস্কার? বাস্তবে কি এর কার্যকারিতা আছে?
বিজ্ঞানীরা মনে করেন—
- নিয়মিত পুজো, উপবাস এবং মানসিক প্রার্থনা এক ধরনের psychosomatic immunity বাড়ায়।
- লাল তাগা শরীরে energy signal তৈরি করে যা ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগায়।
- ব্রত পালন মানেই ‘সেল্ফ ডিসিপ্লিন’, যা স্বাস্থ্য ও সম্পর্ক রক্ষায় বিশেষ সহায়ক।
কেবল নারীর ব্রত নয়, এক সমগ্র জীবনের রক্ষাকবচ
দেবী বিপত্তারিণী কেবল সংসার রক্ষার প্রতীক নন, তিনি নিজেই সেই শক্তি যিনি জীবনের প্রতিটি কঠিন মোড়ে রক্ষা করেন আমাদের। ১৩ নৈবেদ্য, লাল তাগা, উপবাস—সবই তাঁর প্রতি ভক্তির বহিঃপ্রকাশ, আর ভক্তি যদি হয় বিশুদ্ধ, তবে শাস্ত্র বলে—দেবী কখনও ফেরান না তাঁর অনুগামীকে।
আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের জানান। আপনি কি বিপত্তারিণী ব্রতের ফল পেয়েছেন কোনোভাবে? এই লেখাটি আপনার বন্ধুকে শেয়ার করুন যিনি জীবনের কঠিন সময় পার করছেন—দেবীর কৃপায় তাঁর পথও হতে পারে আলোকময়।
🔴 জয় মা বিপত্তারিণী! 🔴
✍️ Asian Top 10 Astrologer Sri Joydeb Sastri
#BipattariniPuja #TantraJyotish #RedThreadMystery #AstrologyBlog #13NaivedyaSecret #VedicRituals #WomenPower #MysticalIndia #JoydebSastri