এই সময়ের আচার, নিষেধ, এবং তন্ত্রশাস্ত্রসম্মত নিয়মাবলি শুধুমাত্র আস্থাভাজন তান্ত্রিকদের জন্য – জনসাধারণের অনুসরণে এর প্রকৃত ফল নিষ্ফলই থেকে যেতে পারে। আসুন দেখি, এই অম্বুবাচীর প্রকৃত অর্থ, মাহাত্ম্য এবং কেন এটি সকলের পালন করার নয়।
অম্বুবাচী: শুধুই ঋতুমতী ধরিত্রী নাকি এক শক্তিশালী তান্ত্রিক বন্ধন?
পুরাণ অনুযায়ী, সতীর শরীরের যে অংশগুলি শিবের ক্রোধে ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পতিত হয়েছিল, সেই স্থানগুলি সতীপীঠ নামে পরিচিত। কামাখ্যা পীঠ, যেখানে সতীর যোনি পতিত হয়েছিল, তা অম্বুবাচী উৎসবের প্রধান কেন্দ্র। এই সময়টিকে ধরিত্রী দেবীর ঋতুকাল হিসেবে ধরা হয় — কিন্তু এটি কোনও সাধারণ ঋতুচক্র নয়। বাস্তবে, এটি হচ্ছে ধরিত্রী মাতার জৈব-আধ্যাত্মিক শক্তির গূঢ় প্রবাহ যেখানে প্রতিটি উদ্ভিজ, প্রাণী ও মানুষের চেতনার ওপর প্রভাব পড়ে।
এমনকি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেখা গেছে – এই সময় মাটির আর্দ্রতা বাড়ে, জলস্তর ওঠে, এবং জীববৈচিত্র্য নতুনভাবে সঞ্চারিত হয়। তান্ত্রিকরা বলেন, এই সময় ধরিত্রী মাতার গর্ভে ‘আকাশিক সঞ্চার’ ঘটে — যা জীবজগতে চেতনার উত্তরণ ঘটায়।
সকলের জন্য নয় এই ব্রত: কেন সধবা নারীরা এই ব্রত পালন করতে পারেন না?
অম্বুবাচীর মূলতঃ তিন দিনের (কখনও চার) এই শুদ্ধিকরণ তিথিতে সধবা নারী বা সংসারী দম্পতিরা অংশ নিতে পারেন না। এই ব্রতের জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে তপস্যার উপযুক্ততা থাকা আবশ্যক। সাধারণ নারী বা গৃহস্থ জীবনের মানুষের জন্য এই ব্রত নয়, কারণ এই ব্রতের মূলভাবই হল ধরিত্রী মাতার সঙ্গে চেতনার একাত্মতা — যার জন্য কঠোর সংযম, ত্যাগ এবং অন্তর্দর্শন অপরিহার্য।
এই ব্রত পালন করেন:
- বিধবা নারী যাঁদের কামচেতনার বন্ধন নেই
- ব্রহ্মচারী এবং সন্ন্যাসীরা যাঁরা শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভ্যস্ত
- তান্ত্রিক সাধক যাঁরা অম্বুবাচীর তামসিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম
অম্বুবাচী পালন করতে গেলে মেনে চলতে হবে এই কঠোর নিয়মগুলি
১. আগুনে রান্না সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
এই তিথিতে ধরিত্রী মাতার ‘রজস্বলা’ দশা চলায় তাঁকে উত্তপ্ত করা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। রান্না বা আগুন ব্যবহার সরাসরি নিষিদ্ধ। ফলমূল, চিঁড়ে, সাবুদানা বা শীতল খাদ্যগ্রহণ করতে হবে। গ্যাস ওভেনেও রান্না চলবে না।
২. ব্যবহার্য বস্ত্র শুদ্ধ রাখা আবশ্যক
তিন দিনের ব্যবহৃত পোশাক, চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে রাখা যাবে না। আলাদা করে রাখা, ব্রতের শেষে সাবানজল দিয়ে ধুয়ে বিশুদ্ধ করা আবশ্যক।
৩. স্নান ও প্রসাধন সামগ্রী নিষিদ্ধ
তেল, সাবান, শ্যাম্পু প্রভৃতি ব্যবহার করা যাবে না। স্নান না করে ব্রত পালন করতে হবে। শেষে, চতুর্থ দিনে গঙ্গাজলে স্নান করে, বিশুদ্ধ বস্ত্র পরে ব্রত সমাপ্ত করতে হবে।
৪. ঘরের দেবীমূর্তি ঢেকে রাখতে হবে
এই সময় দেবীও বিশ্রামে থাকেন। দেবী লক্ষ্মী, দুর্গা বা অন্যান্য শক্তিরূপদের মুখ লাল বা হলুদ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। তিথি শেষে দেবীকে স্নান করিয়ে, নতুন বস্ত্র পরিয়ে পুজো করা আবশ্যক।
৫. ঘর শুদ্ধিকরণ বাধ্যতামূলক
তিন দিন শেষে, ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করতে হবে। কেবলমাত্র নিজেকে বিশুদ্ধ করলেই হবে না, ঘরের প্রতিটি কোণ শুদ্ধ করতে হবে।
তন্ত্র অনুযায়ী অম্বুবাচীকালীন বিশেষ টোটকা ও প্রয়োগ
১. কৃষ্ণ রাত্রিতে নির্জনে কামাখ্যা বীজমন্ত্র জপ করুন – “ক্লীং কামাক্ষ্যৈ নমঃ।” অন্তত ১০৮ বার রুদ্রাক্ষ মালায় জপ করলে কামনা সিদ্ধির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
২. অম্বুবাচীর রাতে শ্মশানে কালো সাদা কাপড় পরিহিত তান্ত্রিক বস্তু যেমন লাল চন্দন, হিং, সরষে ও কাঁচা দুধ সহ রক্তবর্ণ মোমবাতি জ্বালান – এই আচার বিপুল তামসিক শক্তি আহ্বান করে, যা নেগেটিভ শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
৩. আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য কালা জাদু প্রতিরোধে কালো সুতার 'কামাখ্যা কবচ' ধারণ করুন।
উপসংহার: অম্বুবাচী শুধুমাত্র আচার নয়, এটি শক্তির এক গোপন দ্বার
অম্বুবাচী পালন করার আগে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি, শুদ্ধতা এবং ত্যাগের মানসিকতা যাচাই করুন। কেবলমাত্র সামাজিক অনুসরণ নয় — আত্মিক তপস্যা, অন্তর্দর্শন এবং তান্ত্রিক জ্ঞান ছাড়া এই ব্রত ফলে পৌঁছানো অসম্ভব। অনেকেই কেবল লোকরীতি বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব থেকে এই ব্রত পালন শুরু করেন — কিন্তু ফল লাভের চেয়ে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি হতে পারে। তাই এই অতি গুপ্ত এবং শক্তিশালী তিথিকে বুঝে, জানে, এবং যথাযথভাবে পালন করুন — না হলে ‘রজস্বলা ধরিত্রী’র অভিশাপ অনিবার্য।
জ্যোতিষাচার্য শ্রী জয়দেব শাস্ত্রী (Asian Top 10 Astrologer)
#অম্বুবাচী২০২৫ #কামাখ্যাদেবী #তন্ত্রসাধনা #রহস্যময়ভক্তি #AstrologyBengali #TantraRituals #AmbubachiTotka #VedicRules #অশুচিকাল #AstroJoydevSastri