🌕 পূর্ণিমা ও তিথি: চন্দ্র-সূর্যের নৈসর্গিক খেলা
তিথি গণনার মূল ভিত্তি হল সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যবর্তী কৌণিক দূরত্ব।
যখন সূর্য ও চন্দ্র একই রেখায় (মানে ০° কৌণিক দূরত্বে) অবস্থান করে, তখন হয় অমাবস্যা।
চন্দ্র যখন সূর্যের থেকে ১২° দূরে চলে যায়, তখন শুরু হয় প্রতিপদ।
এইভাবে প্রতি ১২° দূরত্বে এক একটি তিথি নির্ধারিত হয়।
চন্দ্র যখন সূর্য থেকে ১৮০° দূরত্বে চলে যায়, তখন হয় পূর্ণিমা — চাঁদের সর্বোচ্চ উজ্জ্বল রূপ।
📅 গুরুপূর্ণিমা ২০২৫: পবিত্র তিথির সময়সূচি
এই বছর, গুরুপূর্ণিমা পড়ছে —
🗓 বাংলা তারিখে: ২৫ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার
🗓 ইংরেজি তারিখে: ১০ জুলাই, ২০২৫, বৃহস্পতিবার
পঞ্জিকা অনুসারে দুই রকম সময় গণনা পাওয়া যায়:
✅ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে:
🔹 পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ:
– ২৪ আষাঢ়, বুধবার | ৯ জুলাই, রাত ১:৩৮ মিনিট
🔹 পূর্ণিমা তিথি শেষ:
– ২৫ আষাঢ়, বৃহস্পতিবার | ১০ জুলাই, রাত ২:০৭ মিনিট
✅ গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুসারে:
🔹 পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ:
– ২৪ আষাঢ়, বুধবার | রাত ১:১৯ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড
🔹 পূর্ণিমা তিথি শেষ:
– ২৫ আষাঢ়, বৃহস্পতিবার | রাত ২:০২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড
গুরুপূর্ণিমার ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
গুরুপূর্ণিমা একটি মাত্র পূর্ণিমা নয়—এটি হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈন ধর্ম, এবং বৈদিক সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত জ্ঞানচর্চা ও আত্মিক উন্নয়নের মহান উৎসব। এই তিথির মাহাত্ম্য ঐতিহাসিক, শাস্ত্রীয় এবং তান্ত্রিক—তিনটি স্তরে বিবেচ্য।
📜 ১. মহর্ষি বেদব্যাসের জন্ম ও গুরু-তত্ত্বের প্রবর্তন
গুরুপূর্ণিমার প্রধান মাহাত্ম্য নিহিত আছে মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মতিথিতে। এই পূর্ণিমা দিনেই মুনি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন ভগবান বেদব্যাস। তাঁর প্রকৃত নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। “বেদব্যাস” শব্দটির অর্থ – যিনি বেদকে ভাগ করেছেন।
তাঁর অবদান:
- চারটি বেদ (ঋগ, সাম, যজুর, অথর্ব)-কে সংকলন ও সংরক্ষণ
- উপনিষদ ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রতিষ্ঠা
- মহাভারতের রচয়িতা এবং ভগবদ্গীতার সঙ্কলন
- ১৮টি মহাপুরাণ ও উপপুরাণ রচনা, যার মধ্যে আছে শ্রীমদ্ভাগবতম, বিষ্ণু পুরাণ, দেবী ভাগবত, ইত্যাদি
এই কারণেই তাঁকে "আদিগুরু" তথা আদি আধ্যাত্মিক শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়। গুরুপূর্ণিমার দিন তাই কেবল তাঁকে স্মরণ নয়—জ্ঞান, শাস্ত্র ও আলোকের প্রতি এক নিঃশর্ত নতজানুতা।
🕉️ ২. গুরুর আধ্যাত্মিক সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
“গুরু” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “গু” (অন্ধকার) এবং “রু” (নাশকারী) শব্দ থেকে। অর্থাৎ, যিনি অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান—তিনিই গুরু।
শাস্ত্র বলে:
“गुरुर्ब्रह्मा गुरुर्विष्णु गुरुर्देवो महेश्वरः।
গুরুঃ সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥”
এই তিথিতে:
- আত্মিক অন্ধকারে নিমজ্জিত শিষ্যকে গুরু জ্ঞানের আলো দেন
- কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, গুরু হলেন অনুভবের দর্পণ
- গুরু ছাড়া মন্ত্রদীক্ষা, তন্ত্রসাধনা ও মোক্ষ - তিনটিই অসম্ভব
🔱 ৩. মহাদেব ও সাত ঋষি: তান্ত্রিক গুরুতত্ত্বের সূচনা
এই তিথির গভীরে লুকিয়ে রয়েছে এক তান্ত্রিক ঐতিহ্য।
শাস্ত্র মতে, এই দিনেই দেবাদিদেব মহাদেব কৈলাসে সপ্ত ঋষিকে প্রথম তত্ত্ব-জ্ঞান দেন।
তিনি বলেছিলেন:
“জ্ঞানহীন ভক্তি অন্ধ, আর গুরু ছাড়া জ্ঞান বিপথগামী”
এই গুরুপূর্ণিমা তাই শুধু এক গুরু বা শিক্ষকের স্মরণ নয়—এটি সেই আদ্য মহাগুরু শিবের উপাসনার দিন।
এই দিন বহু সাধক অগস্ত্য, ভৃগু, কশ্যপ, গৌতম, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, জামদগ্নি – এই সাত ঋষিকে গুরুরূপে পুজো করেন।
🕊️ ৪. বুদ্ধ ও গুরুপূর্ণিমার উপদেশচর্চা
বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী, গুরুপূর্ণিমার তিথিতে বোধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধ তাঁর পাঁচ অনুচর শিষ্যকে প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। এই দিন তিনি মধ্যমার্গ ব্যাখ্যা করেন—যা চূড়ান্ত আত্মজ্ঞান ও নির্বাণের দিকনির্দেশ দেয়।
তাঁর উপদেশ ছিল:
“অতিশয় ভোগ ও অতিশয় ত্যাগ—উভয়ই অন্ধকার। চলো মধ্যপথে, যেথা জ্ঞান ও করুণা মিলিত।”
এই শিক্ষার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ ধর্মের গুরুসংপ্রদায়।
🕯️ ৫. জৈন ধর্মে গুরুপূর্ণিমার ভূমিকা
জৈন ধর্ম মতে, এই দিনেই ভগবান মহাবীর তাঁর প্রথম শিষ্যকে দীক্ষা দান করেন। এই দীক্ষা ছিল “তপ, ব্রহ্মচর্য ও সংযম”-এর দীক্ষা। তাই এই তিথিকে “উপদেশ দিবস” বলা হয়।
এই দিন জৈন শিষ্যরা গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে “গুরুস্তোত্র” পাঠ করেন এবং তপস্যার সূচনা করেন।
গুরুপূর্ণিমা পালনের নিয়ম ও কার্যকর তন্ত্রভিত্তিক টোটকা
🕉️ ব্রাহ্ম মুহূর্তে এই কাজগুলি করুন:
- শুদ্ধ বস্ত্রে পূর্ব বা উত্তর দিকে মুখ করে বসুন।
- গুরুর নাম, বা মহর্ষি বেদব্যাসের নাম উচ্চারণ করে ১০৮ বার "ॐ गुरवे नमः" জপ করুন।
- গোলাপি বা হলুদ ফুল, ফল ও মধু দিয়ে গুরু ও দেবতাকে অর্ঘ্য দিন।
- গুরু বা শিক্ষকের পায়ে ধুলো (যদি জীবিত হন), না হলে তাঁর ছবিতে চরণামৃত দিন।
- তামার পাত্রে গঙ্গাজল রেখে তাতে তুলসী পাতা ও চন্দন মিশিয়ে নিজেও স্পর্শ করুন এবং বাড়িতে ছিটিয়ে দিন।
🧿 তান্ত্রিক টোটকা (শুধু অভিজ্ঞদের জন্য):
উপকরণ: ধুতরা ফুল, বিল্বপত্র, কালো তিল, ঘৃত দিপ
মন্ত্র: "ॐ वागीशाय नमः"
– এই মন্ত্র ১১ বার জপ করে একটি ধুতরা ফুল মহাদেবের শিবলিঙ্গে অর্পণ করলে জ্ঞান, স্মৃতি ও গুরু কৃপা লাভ নিশ্চিত।
📿 কেন পালন করবেন গুরুপূর্ণিমা?
এই তিথি হল জীবনের সব বাধা, মায়া ও অজ্ঞানতা দূর করার শ্রেষ্ঠ সময়।
যাঁদের জীবনে গুরু নেই, তাঁরা মহর্ষি বেদব্যাস বা শিবকেই তাঁদের অন্তর্জগতে গুরু রূপে কল্পনা করে পুজো করতে পারেন।
🙏 শেষ কথা:
গুরুপূর্ণিমা শুধু একটি পূর্ণিমা নয় — এটি আত্মজাগরণ, আত্ম-পরিশুদ্ধি এবং জ্ঞানলাভের শুভ মুহূর্ত।
এই দিনে যদি আপনি মন থেকে অন্তর্জ্ঞান কামনা করেন, আপনার জীবনে এক অলৌকিক পরিবর্তন আসবেই।
📌 লিখেছেন: Asian Top 10 Astrologer Sri Joydeb Sastri
📢 "যে গুরুর সামনে নত হয় মন, সেখানেই জেগে ওঠে ব্রহ্মজ্ঞানের আলো..."
📲 শেয়ার করুন এই জ্ঞান অন্যদের সঙ্গে, এবং গুরুপূর্ণিমায় লাভ করুন সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ।
#GuruPurnima2025 #VedVyasJayanti #TantrikTotka #JoydebSastri #AstrologyBengali #PurnimaPuja #জ্যোতিষ_উপদেশ #MahadevBlessings