অশোক ষষ্ঠী: পুণ্য তিথি, ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও বিস্তৃত পালনের বিবরণ
ভূমিকা
অশোক ষষ্ঠী হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রত ও উৎসব, যা বিশেষত নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়। এটি প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত হয়। এই ব্রত মূলত মা পার্বতী ও দেবী অশোকের প্রতি ভক্তি নিবেদন করে পালন করা হয়। বিশেষ করে, মা দুর্গার এক রূপ হিসেবে দেবী অশোককে পুজো করা হয়, যিনি সকল প্রকার দুঃখ ও শোক দূর করেন।
এই ব্রত পালনের মাধ্যমে নারীরা তাঁদের পরিবারের সুখ, সমৃদ্ধি ও সন্তানদের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। প্রাচীন কালে রাজবংশীয় ও অভিজাত পরিবারের মহিলারা সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর জন্য এই ব্রত করতেন। এটি বিশেষত পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বিহারে ব্যাপকভাবে পালিত হয়।
২০২৫ সালের অশোক ষষ্ঠীর তারিখ ও শুভ মুহূর্ত
- পালনের তারিখ: ৩ এপ্রিল ২০২৫
- ষষ্ঠী তিথি শুরু: ২ এপ্রিল ২০২৫, রাত ১১:৪৫ মিনিট
- ষষ্ঠী তিথি সমাপ্ত: ৩ এপ্রিল ২০২৫, রাত ১:৩০ মিনিট
- পুজোর শুভ সময়: ৩ এপ্রিল সকাল ৮:০০ থেকে দুপুর ১২:০০ পর্যন্ত
অশোক ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য ও উপকারিতা
অশোক শব্দের অর্থ হল "যে শোক দূর করে"। এই ব্রত পালন করলে দাম্পত্য জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে, সন্তানদের মঙ্গল হয় এবং পারিবারিক সুখ-শান্তি বজায় থাকে। ব্রতটি পালনের মাধ্যমে নারীরা পরিবারের কল্যাণ কামনা করেন এবং জীবনের সকল বাধাবিপত্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা করেন।
এই ব্রত পালনের উপকারিতা
- দাম্পত্য কলহ দূর হয় ও সম্পর্ক মজবুত হয়।
- সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভ হয়।
- পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।
- মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় ও হতাশা দূর হয়।
- নেতিবাচক শক্তি ও দুঃখ দূর হয়।
অশোক ষষ্ঠী পালনের বিধি ও রীতি
১. ব্রতের প্রস্তুতি ও উপবাস
- ব্রতধারীরা সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করেন।
- উপবাস রেখে সারা দিন দেবীর পুজো করেন।
- ব্রত চলাকালীন নিরামিষ খাবার গ্রহণ করা হয়।
- শুদ্ধ মনে ও শুদ্ধ পরিবেশে এই ব্রত পালন করতে হয়।
২. দেবী অশোকের পুজো
- দেবী অশোকের মূর্তি বা চিত্র সামনে রেখে পূজা করা হয়।
- অশোক গাছের পাতা ও ফুল ব্যবহার করে দেবীকে পূজার নিবেদন করা হয়।
- ধূপ, দীপ, ফুল, চন্দন, প্রসাদ ও নানা উপকরণ দিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়।
৩. অশোক বৃক্ষের পূজা
অশোক গাছ এই ব্রতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- ব্রতধারীরা অশোক গাছের নিচে গিয়ে দেবীর মন্ত্র জপ করেন।
- গাছের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে পুজো সম্পন্ন করা হয়।
- অশোক গাছের পাতা সংগ্রহ করে তা পরিবারের সদস্যদের মাথায় ছোঁয়ানো হয়, যা শোকমুক্তি ও কল্যাণের প্রতীক।
- কিছু এলাকায় মহিলারা অশোক গাছের ছাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে বিশেষ প্রসাদ তৈরি করেন।
৪. বিশেষ মন্ত্র পাঠ ও ব্রতকথা শ্রবণ
এই দিনে বিশেষ ব্রতকথা ও পৌরাণিক কাহিনী পাঠ করা হয়, যেখানে দেবী পার্বতী ও দেবী অশোকের মাহাত্ম্য বর্ণিত থাকে।
- মন্ত্র জপ করা হয়: "ॐ অশোকদেব্যৈ নমঃ।"
- ব্রতকথার মাধ্যমে মহিলারা এই ব্রতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝেন।
অশোক ষষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনী
একটি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মা পার্বতী একবার কঠোর তপস্যা করে দেবাদিদেব মহাদেবকে লাভ করেন। তাঁর তপস্যার সময় অশোক বৃক্ষের ছায়ায় বসে তিনি ধ্যান করেন। তখন থেকেই বিশ্বাস করা হয় যে অশোক গাছ দুঃখ ও শোক দূর করতে সক্ষম। এই কারণে নারীরা অশোক বৃক্ষের পূজা করেন ও ব্রত পালন করেন।
অশোক ষষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান
- মহিলারা স্নান করে নতুন শাড়ি পরে ব্রত পালন করেন।
- দেবী অশোকের চরণে হলুদ, চন্দন, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়।
- ব্রতকথা পাঠ করা হয় ও পরিবারে মঙ্গল কামনা করা হয়।
- অশোক গাছের পাতা ভক্ষণ করা হয়, যা শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে।
উপসংহার
অশোক ষষ্ঠী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি সামাজিক সংস্কার ও সংস্কৃতির অঙ্গ। এই ব্রত পালন করলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এটি মহিলাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ তিথি, যা তাদের পারিবারিক জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
বিশেষ বার্তা:
যদি আপনি এই ব্রত পালন করতে চান, তবে সঠিক বিধি মেনে করুন এবং বাড়ির পণ্ডিতের পরামর্শ নিন। শুভ অশোক ষষ্ঠী!