জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, মানবজীবনের প্রতিটি ওঠাপড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে নবগ্রহের অবস্থান ও প্রভাব।
যে গ্রহ জন্মছকে শুভ অবস্থায় থাকে, সে জীবনে উন্নতি ও শান্তি আনে; আর যেই গ্রহ দুষ্ট অবস্থায় থাকে, তার কুপ্রভাব নেমে আসে জীবনের নানা ক্ষেত্র—স্বাস্থ্য, কর্ম, অর্থ, ও মানসিক স্থিতিতে।
শাস্ত্র বলে, গ্রহদোষ প্রশমন ও ভাগ্যোন্নতির জন্য শুধু রত্নই নয়, গাছের শিকড় বা “মূল তাবিজ” ধারণ করাও সমান কার্যকর।
এই মূল ধারণ করার প্রথা হাজার বছর পুরনো তান্ত্রিক ও বৈদিক জ্যোতিষের অংশ, যেখানে বিশ্বাস করা হয়—প্রতিটি গাছের মূলেই থাকে একেকটি গ্রহের কম্পন বা শক্তি।
🌿 গাছের মূল ধারণ করার নিয়ম ও দর্শন
গাছের মূল (মূলতঃ তাজা, শুষ্ক ও পূর্ণাঙ্গ অংশ) ধারণ করা মানে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তির সঙ্গে নিজস্ব গ্রহশক্তিকে যুক্ত করা।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
- পুরুষদের ডান হাতে
-
মহিলাদের বাঁ হাতে
এই মূল ধারণ করতে হয়।
মূলটি পরার আগে অবশ্যই গ্রহ শান্তি বা সংশ্লিষ্ট গ্রহের পূজা ও দান করা অত্যাবশ্যক।
এবং যার মূল ধারণ করছেন, সেই গ্রহের বীজমন্ত্র ১৬ বার জপ করে তারপরই বাঁধতে হবে।
প্রত্যেক গ্রহের জন্য আলাদা রঙের সুতো ব্যবহার করা উচিত, কারণ প্রতিটি রঙ নিজস্ব গ্রহের কম্পনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
🌞 নবগ্রহ অনুযায়ী মূল ও ধারণ পদ্ধতি
☀️ রবি (সূর্য) গ্রহ
- সমস্যা: আত্মবিশ্বাসের অভাব, চাকরিতে বাধা, মানহানি, পিতৃসমস্যা।
- মূল: বিল্বমূল (বেলগাছের শিকড়)
- সুতো: গোলাপি বা কমলা
- নিয়ম: রবিবার সকালে সূর্যোদয়ের সময় “ওঁ হ্রাঁ হ্রীঁ হ্রৌঁ সঃ সূর্যায় নমঃ” মন্ত্র ১৬ বার জপ করে ধারণ করুন।
- তান্ত্রিক টোটকা: সূর্যোদয়ে মূলটি হাতে নিয়ে প্রণাম করে একবার তামার পাত্রে সূর্যজল উৎসর্গ করলে আত্মসম্মান ও সাফল্য বৃদ্ধি পায়।
🌙 চন্দ্র গ্রহ
- সমস্যা: মানসিক অস্থিরতা, দাম্পত্য ক্লেশ, অনিদ্রা, বিষণ্ণতা।
- মূল: ক্ষীরিকা গাছের মূল
- সুতো: সাদা
- নিয়ম: সোমবার সন্ধ্যায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধারণ করুন।
- টোটকা: প্রতি পূর্ণিমায় এই মূলটিতে দুধ দিয়ে প্রণাম করলে মনশান্তি ও মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে।
🔥 মঙ্গল গ্রহ
- সমস্যা: রাগ, দুর্ঘটনা, জমি বা দাম্পত্য সমস্যা।
- মূল: অনন্তমূল বা খয়ের গাছের শিকড়
- সুতো: লাল
- নিয়ম: মঙ্গলবার সকালে “ওঁ ক্রাং ক্রিং ক্রৌং সঃ ভৌমায় নমঃ” জপ করে ধারণ করুন।
-
টোটকা: মঙ্গল তোষণে মূলটি হাতে নিয়ে ৭ বার আগুন প্রদক্ষিণ করুন এবং পরে গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে পরুন।
🍃 বুধ গ্রহ
- সমস্যা: বুদ্ধির স্থবিরতা, যোগাযোগ ব্যর্থতা, ব্যবসায় ক্ষতি।
- মূল: বৃহদ্বারক মূল
- সুতো: সবুজ
- নিয়ম: বুধবার সকালে “ওঁ বুং বুধায় নমঃ” মন্ত্র জপ করে ধারণ করুন।
- টোটকা: মূলটির সঙ্গে একটি সবুজ পাতা বেঁধে রাখলে বাণিজ্যে উন্নতি হয়।
🍌 বৃহস্পতি (গুরু) গ্রহ
- সমস্যা: অর্থহানি, শিক্ষায় ব্যাঘাত, দাম্পত্য ক্লেশ, গুরুশাপ।
- মূল: কলাগাছের মূল বা জ্যৈষ্ঠ আঁটির মূল
- সুতো: হলুদ
- নিয়ম: বৃহস্পতিবার সকালে ব্রাহ্মণ দান করার পর ধারণ করুন।
- টোটকা: মূলটি পরে একমুঠো চনা ও হলুদ অর্ঘ্য দিন বটগাছের নীচে।
💎 শুক্র গ্রহ
- সমস্যা: সম্পর্ক সমস্যা, সৌন্দর্যহানি, বিলাস হ্রাস, প্রেমহীনতা।
- মূল: রামবাসকের মূল
- সুতো: সাদা বা হালকা গোলাপি
- নিয়ম: শুক্রবার সকালে সুগন্ধি দিয়ে পরিশুদ্ধ করে ধারণ করুন।
- টোটকা: শুক্রবার সন্ধ্যায় মূলের উপর সাদা ফুল অর্পণ করলে প্রেম ও আনন্দ বৃদ্ধি পায়।
🪶 শনি গ্রহ
- সমস্যা: কর্মজীবনে বাধা, ঋণ, দারিদ্র্য, অবসাদ।
- মূল: শ্বেতবেড়লা বা লজ্জাবতী গাছের শিকড়
- সুতো: নীল বা কালো
- নিয়ম: শনিবার সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে “ওঁ প্রাং প্রীং প্রৌং সঃ শনৈশ্চরায় নমঃ” জপ করে ধারণ করুন।
- টোটকা: মূলটি তেল ছোঁয়া রাখবেন না। শনিবার মূলটির সামনে তিল ও লোহা দান করুন।
🐉 রাহু গ্রহ
- সমস্যা: ভ্রান্তি, ভয়, মানসিক চাপ, হঠাৎ ক্ষতি।
- মূল: শ্বেতচন্দনের মূল
- সুতো: নীল
- নিয়ম: শনিবার সন্ধ্যায় দুধে ভিজিয়ে ধারণ করুন।
- টোটকা: অমাবস্যা রাতে মূলটি হাতে নিয়ে “ওঁ রাহু রাহবায় নমঃ” জপ করলে দুর্ভাগ্য নাশ হয়।
🕉️ কেতু গ্রহ
- সমস্যা: অজানা ভয়, কর্মজীবনে হঠাৎ ব্যর্থতা, আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তি।
- মূল: অশ্বগন্ধার মূল
- সুতো: নীল
- নিয়ম: মঙ্গলবার বা বৃহস্পতিবার রাতে ধূপ দিয়ে শুদ্ধ করে ধারণ করুন।
- টোটকা: কেতু দোষ থাকলে মূলটি বালিশের নীচে রেখে ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দূর হয়।
🌼 মূল ধারণের পূজাপদ্ধতি
১️⃣ প্রথমে সকালে স্নান করে পরিষ্কার সাদা পোশাক পরুন।
২️⃣ ধূপ–দীপ জ্বালিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রহের চিত্র বা প্রতীক সামনে রাখুন।
৩️⃣ “ওঁ গ্রহায় নমঃ” মন্ত্র জপ করে মূল হাতে নিন।
৪️⃣ ডান (পুরুষ) বা বাঁ (মহিলা) হাতে রঙিন সুতোয় বেঁধে পরুন।
৫️⃣ শেষে কোনও দুঃস্থ ব্যক্তিকে খাদ্য বা পোশাক দান করুন — এটি মূল ধারণের শক্তি সক্রিয় করে।
🔮 বিশেষ তান্ত্রিক টোটকা (Totka for Planet Activation)
- প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে, আপনার মূলটি পরিষ্কার করে গঙ্গাজলে ধুয়ে নিন ও প্রদীপের আলোয় শুকিয়ে নিন।
- শনিবার রাতে মূলের কাছে এক ফোঁটা সর্ষের তেল ফেলে বলুন — “আমার কর্ম বাধা দূর হোক।”
- বৃহস্পতি বা শুক্র দোষ থাকলে, মূলের সঙ্গে হলুদ বা সাদা চন্দন রাখলে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।
- চন্দ্র বা রাহু দোষ থাকলে, মূলের কাছে নিমপাতা রাখলে মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে।
✨ উপসংহার
গ্রহের শক্তি কেবল আকাশের কোনো জ্যোতিষ পিণ্ড নয় — তা আমাদের শরীর, মন, এবং কর্মের প্রতিটি পরতের সঙ্গে যুক্ত।
গাছের মূল ধারণের এই প্রাচীন উপায় আমাদের প্রকৃতির জীবন্ত শক্তির সঙ্গে গ্রহীয় কম্পনকে একাত্ম করে।
যে ব্যক্তি এই নিয়ম মেনে মূল ধারণ করেন, তার জীবনে ধীরে ধীরে দেখা দেয় ভারসাম্য, আত্মবিশ্বাস, সাফল্য এবং শান্তি।